রাজধানীর বনানী থানার ওসি বি এম ফরমান আলী এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষিতা দুই ভার্সিটি ছাত্রীর মামলা গ্রহণে গড়িমসি এবং ধর্ষকদের বাঁচানোর চেষ্টা করে আলোচনায় আসে সে। এরপর থেকে একের পর এক তার কীর্তিকলাপের কাহিনী বেরিয়ে আসছে। পুলিশের চাকরির প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পথ অবলম্বন করে সে আজ সমালোচিত। গত সোমবার একটি জাতীয় দৈনিকে এই কীর্তিমান (!) ওসি’র কর্মকান্ডের কিঞ্চিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে সাধারণ মানুষের বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা এমন সব বেআইনী কাজে লিপ্ত থাকতে পারে এটা ভাবাই যায় না।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে ফরমান আলীকে ‘গুণধর’ ওসি হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছে- তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। নিরপরাধ লোকজনকে ধরে নিয়ে টাকার জন্য হয়রানি, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে আসামীদের পক্ষ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, একজন ওসি’র সাকুল্যে বেতন-ভাতা মাসে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা হলেও ফরমান আলী ৭০ লাখ টাকা দিয়ে উত্তরা ক্লাবের মেম্বারশীপ কিনেছে। তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও কেউ কিছুই করতে পারছে না। সে অত্যন্ত প্রভাবশালী। উপর মহলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আর্শীবাদ থাকায় হরেক রকম অপরাধ করেও বহাল তবিয়তে থাকছে সে। এমন কি পুলিশ কর্মকর্তারাও তাকে ‘সমীহ’ করে চলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, গত ২১ ফেব্রুয়ারি বনানীর ঢাকা গেট এলাকা থেকে আনোয়ার নামে এক ব্যক্তিকে ধরে এনে ইয়াবাসহ মামলা দেয়ার ভয় দেখিয়ে ফরমান আলী এক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। গত মার্চ মাসের শুরুতে মহাখালী এলাকার কড়াইল বস্তির কাছে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে চার যুবক। তরুণী মামলা করতে গেলে ওসি ফরমান আলী অভিযোগপত্রটি ছিড়ে ফেলে দেয়। তরুণী পরে আদালতে মামলা করে। তবে, ফরমান আলী সাংবাদিককে বলেছে, সে বেআইনী কোনো কাজ করে না, কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িতও নয়। ৭০ লাখ টাকায় উত্তরা ক্লাবের সদস্য হওয়ার প্রশ্নে ওসি ফরমান আলী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছে, এখানে টাকার প্রশ্ন আসে কেন ? সদস্য হতে টাকা লাগার বিষয়টি নাকি তার জানা নেই। নিম্ন পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা যখন বিপুল টাকা ব্যয়ে অভিজাত একটি ক্লাবের সদস্য পদ ক্রয় করে। এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না তার অবৈধ উপার্জনের পরিমাণ কত!
দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কিংবা দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষ পুলিশের দ্বারস্থ হয়। সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। তাছাড়া দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ পুলিশের দায়িত্ব এটাও সবারই জানা। তবে, আমাদের পুলিশ বাহিনীর একটি অংশে এখন নীতি নৈতিকতা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। অর্থলোভ তাদেরকে যেন অন্ধ করে দিয়েছে। টাকার জন্য এরা করতে পারে না, এমন কোনো অপকর্ম নেই। এরা টাকার জন্য নিরীহ মানুষদের হয়রানি করে, টাকার বিনিময়ে দুষ্কৃতকারীদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। এরা ভুক্তভোগীদের কথা আমলে না নিয়ে অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয়। ফরমান আলী ওইসব দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের প্রতিকৃতি।
খবরেই বলা হয়েছে, ওসি ফরমান আলী ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। সে এটা বোঝাতে চায় যে, তার কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতাও কারো নেই। বাস্তবিক তাই। গোটা পুলিশ প্রশাসনে ফরমান আলীর অপকর্মের কথা চাউর হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। খবরে বলা হয়েছে, বিগত বিএনপি সরকারের আমলে নানা অপকর্মের জন্য ফরমান আলী সামরিক বরখাস্ত হয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর চাকরি ফিরে পাবার পাশাপাশি তার প্রভাব প্রতিপত্তিও বেড়ে গেছে। বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, যাদের দয়ায় সে চাকরি ফিরে পেয়েছে, তারাই তার মাথার ওপর বটবৃক্ষের ন্যায় ছায়া দিয়ে চলেছে।
বর্তমানে পুলিশ প্রশাসনে অনুসন্ধান চালালে এমন অনেক ফরমান আলীর খোঁজ পাওয়া যাবে, যারা ক্ষমতাসীন মহলের আশীবার্দ পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে যা খুশী করে বেড়াচ্ছে। এদের কাজকর্মের জবাবদিহিতার যেনো কেউ নেই। একেকজন ওসি যেন সংশ্লিষ্ট এলাকার রাজাধিরাজ।
আইনের শাসনের কথা আমাদেরকে প্রায়ই শুনতে হয়। কিন্তু ফরমান আলীদের কারণে ‘আইনের শাসন’ থেকে ‘আইন’ উঠে গেছে, পড়ে আছে ‘শাসন’। সে শাসনও পরিণত হয়েছে দুঃশাসনে। এরা হাজারো অপকর্ম করলেও কেউ তাদের টিকিটি ছুঁতে পারে না। কারণ তারা ‘প্রভাবশালী’ মহলের আস্থাভাজন। প্রভাবশালীদের ইচ্ছা পূরণ করতে যেমন তারা সদা প্রস্তুত, তেমনি আপদে বিপদে প্রভাবশালীরাও তাদেরকে রক্ষা করে থাকেন। ফলে ঘুষ খাওয়া থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ধর্ষণসহ সব ধরনের অপকর্মেই তারা সংশ্লিষ্ট হয়। মাথার ওপর রক্ষাকর্তা থাকতে ভয় কি যা খুশি তা করতে!
ফরমান আলীর কর্মকান্ডের কাহিনী গণমাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার হওয়ার পর সর্বত্র আলোড়ন সুষ্টি হয়েছে। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, এই ওসি’র বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিত্তে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তদন্ত হওয়া উচিত তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কলুষমুক্ত করতে হলে ফরমান আলীদের মতো পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে পদক্ষেপ কি আদৌ নেয়া হবে ? দেশের আপামর জনসাধারণের প্রশ্ন এখন একটাই- ওসি ফরমান আলী কি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে, নাকি প্রভাবশালীদের আশীর্বাদে বহাল তবিয়তে থেকে তার অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকবে ? ।