২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:২৯

সুলতান সুলেমান হওয়ার পথে এরদোগান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান এএফপির ফাইল ছবিতুর্কি টিভি সিরিজ ‘সুলতান সুলেমান’–এর কল্যাণে অটোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের আভাস দেখতে চাইছেন অনেকেই। ওই কাহিনিতে সুলতান সুলেমানকে মাঝেমধ্যেই গর্বভরে বলতে শোনা যায়, ‘আমি তিন মহাদেশের বাদশাহ…।’ অটোমান বা উসমানিয়া সাম্রাজ্যকে সুলতান সুলেমানই সবচেয়ে বড় করতে পেরেছিলেন, যা তিন মহাদেশে বিস্তৃত হয়েছিল। বলকান অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা, মধ্য ইউরোপের একাংশ, এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সুলতান সুলেমানের সাম্রাজ্য।

অটোমান সাম্রাজ্যের (১২৯৯-১৯২২) কেন্দ্রবিন্দু ছিল মূলত বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহর। এই সাম্রাজ্যেরই ‘উত্তরসূরি’ হলো বর্তমান তুরস্ক। দেশটির রাজনীতিতে ‘নব্য অটোমানবাদ’ (Neo-Ottomanism) ধারণা বেশ প্রচলিত। যার মূল্য লক্ষ্য তুরস্কসহ সাবেক অটোমান সাম্রাজ্যের সব অঞ্চলে বিস্তৃত অর্থে তুর্কি রাজনীতি, ওই সময়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে এগিয়ে নেওয়া। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও এই ধারণায় বিশ্বাসী বলে মনে করেন কেউ কেউ। এরদোয়ান অবশ্য নানাভাবে এর আভাসও দিয়েছেন। কয়েক মাস আগে সরকারি স্কুলগুলোর এক অনুষ্ঠানে এরদোয়ান সরাসরিই বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে তুরস্ক এমন ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী হবে, যেমন ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ছিল অটোমান সাম্রাজ্য।

২০১৪ সালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এরদোয়ান। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ১১ বছর (২০০৩-২০১৪) দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারও আগে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের মেয়র ছিলেন তিনি। বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁর দল একে পার্টি অটোমান সাম্রাজ্যের স্লোগান ব্যবহার করে। সমর্থকদের তিনি ‘অটোমান সুলতানদের নাতিপুতি’ বলে অভিহিত করেন। একে পার্টির পররাষ্ট্রনীতিতেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। গত বছরের জুলাইয়ে এরদোগানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তিনি যেন বেশি করে ‘নব্য অটোমানবাদের’ দিকে ঝুঁকেছেন। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তিনি আরও শক্তিশালী হয়েছেন। ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দেশটির প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাজারো সদস্যকে আটক করে বিচারের মুখোমুখি করেছেন। গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এক রায়ে অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার দায়ে ৪০ জনকে যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়েছেন একটি আদালত। আরও অনেক মামলা বিচারাধীন। এরদোয়ান কঠোর অবস্থান নিয়েছেন রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে। একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ফেতুল্লাহ গুলেন ও তাঁর অনুসারীদের সন্ত্রাসী ঘোষণা করেছেন তিনি।

এসবের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সফল সুলতান সুলেমানের সঙ্গে এরদোগানের উচ্চাকাঙ্ক্ষার মিল খুঁজে পান কেউ কেউ। সুলেমান তাঁর নীতি এবং সাম্রাজ্যের স্বার্থের হুমকি মনে করলে কাউকে ছাড় দিতেন না। আইনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন কঠোর। এ জন্য তাঁর আরেক নাম ‘কানুনি সুলতান’। একান্ত সহচর প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম পাশাকে এমনকি নিজের সন্তান শাহজাদা মুস্তাফাকেও মৃত্যুদণ্ড দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। এসবের পাশাপাশি নিজের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে একের পর এক অভিযান চালিয়েছেন তিনি, সফলও হয়েছেন। দুবার, ভিয়েনা অবরোধ করে ইউরোপ দখলের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন। সর্বশেষ ১৫৬৬ সালে এক লাখ সেনা নিয়ে হাঙ্গেরির জিগেতভার দুর্গ অবরোধ করেন সুলতান সুলেমান। কিন্তু দুর্গপতনের আগের রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

‘সুলতান সুলেমান’ টিভি ধারাবাহিকের পোস্টার। ছবি: সংগৃহীতগত বছর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে প্রেসিডেন্ট–শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এরদোগান, যা তাঁকে আরও শক্তিশালী করেছে। পাশাপাশি মনোযোগ দেন আঙ্কারার ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এগিয়ে নেওয়ার ওপর। এ ছাড়া তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) তুরস্কের অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পথে এগোচ্ছেন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও মধ্যপ্রাচ্যের দিকেও মনোযোগ দিয়েছেন।

আরব বিশ্বেও প্রভাব বাড়ছে তুরস্কের। সৌদি আরব-কাতার সংকট সমাধানে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন। ইরানের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে দেখা যাচ্চে। সিরিয়া ও ইরাকের বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের সঙ্গে মতাদর্শগত ভিন্নতা আছে এরদোয়ানের। এই দুই দেশের ক্ষমতাসীনেরা শিয়াপন্থী আর এরদোয়ান সুন্নিপন্থী। কিন্তু তিনি সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারকে উৎখাতে আইএসের হামলায় সমর্থন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সিরিয়া ও ইরাক থেকে লুট করা জ্বালানি প্রচলিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে তুরস্কের কাছে বিক্রি করে আইএস। কিন্তু সেই এরদোয়ানই অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন যুক্তরাষ্ট্র ও আইএসের বিপক্ষে, যোগ দিলেন পুতিন-আসাদ শিবিরে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যুতেও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন তিনি; সহায়তা পাঠানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে সোচ্চার হয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশ সফরে পাঠান স্ত্রীকে।

অটোমান শাসক সুলতান সুলেমান বলকান দেশগুলোতে একই সঙ্গে ভালোবাসা ও ঘৃণার নাম। এই বিরাট ভূখণ্ড জয় করেছিলেন উসমানিয়া সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের এই নায়ক। ‘নব্য অটোমানবাদী’ এরদোয়ান তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন এই বলকান দেশগুলোকে। বলকান অঞ্চলের আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, কসভো, মন্টেনেগ্রো, মেসিডোনিয়ার পুরো এলাকা এবং গ্রিস, রোমানিয়া, ইতালি, সার্বিয়ার একাংশ একসময় অটোমান সাম্রাজ্যেরই যে অংশ ছিল, তা ভুলতে দিতে চাইছেন না পৃথিবীকে। এরদোয়ানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগ্লু তাঁর ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ: টার্কি’স ইন্টারন্যাশনাল পজিশন’ বইয়ে আজকের তুরস্কের জন্য বলকান অঞ্চলের গুরুত্ব তুলে ধরে লিখেছেন, ‘বলকান দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে পারলে তুরস্ক নিজেকে ইউরোপীয় শক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারবে।’ চলতি মাসের ১০ তারিখ এরদোয়ান রাষ্ট্রীয় সফরে সার্বিয়া যান। তাঁর সফরের সময় সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুসিস বলেন, ‘সার্বিয়াসহ পুরো বলকান অঞ্চল—আমরা সব সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিতে চাই। সার্বিয়া তুরস্ককে বন্ধু হিসেবেই বিবেচনা করে।’ সার্বিয়ার প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য এরদোয়ানের নীতির সাফল্য বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। আর তুরস্কের ব্যাপারে বলকানসহ অন্য দেশগুলোর অবস্থান সার্বিয়ার মতো বলেই মনে করা হয়।

এরই মধ্যে এরদোগানকে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন কেউ কেউ। সামাজিক গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অনেকে সাংবাদিককে জেলেও পুরেছেন তিনি। তুরস্কের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কোনো কোনো মানবাধিকার সংগঠন। কিন্তু নিজের লক্ষ্যে যেন অবিচল ৬৩ বছর বয়সী এরদোয়ান। আর এ কারণেই সমালোচকেরা এরদোয়ানকে আখ্যা দিয়েছেন ‘অটোমান সুলতান’ নামে।

এককেন্দ্রিক বিশ্বের পুরনো ক্ষমতাবিন্যাস বদলে যাচ্ছে দ্রুত। চীনের উত্থান, রাশিয়ার ফিরে আসার পটভূমিতে তুরস্ক ও তার সুলতান এরদোগান কতটা পথ করে নিতে পারেন, তা সময়ই বলে দেবে।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :অক্টোবর ২৬, ২০১৭ ২:০৩ অপরাহ্ণ