নিজস্ব প্রতিবেদক:
মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়ে আসা ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া উপজেলার আঞ্জুমানপাড়ায় গত তিনদিন ধরে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ওই এলাকায় আশ্রয়ের স্থান না থাকায় ধানক্ষেতের মাঝখানে ছোট ছোট বাঁধের ওপর তাঁবু টাঙিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অচিরেই তাদের বাংলাদেশে ঢোকার সুযোগ না দিলে খাদ্য ও নিরাপদ পানির অভাবে রোগশোক ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা ঢল গত কিছুদিন ধরে কমে আসলেও একদিনে হঠাত্ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। পরে আরো রোহিঙ্গা ঢল নামে। এ সময় বিজিবি তাদের আটকে দিলে রোহিঙ্গারা সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে চলে আসলেও এখনো ৩০/৩৫ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে অবস্থান করছে। সীমান্তের ওই জিরো পয়েন্টে গণমাধ্যমকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা সেখানে ত্রাণ, শুকনো খাবার বিতরণ ও মেডিক্যাল ক্যাম্প করে রোহিঙ্গাদের সেবা দিচ্ছে।
আনজুমানপাড়া মেডিক্যাল ক্যাম্পে চিকিত্সা নিতে আসা কাউয়ারখোপ গ্রামের সোনা আলী (৪৫) জানান, বুচিডং শহরে প্রায় ৩৫টি গ্রামের মধ্যে ১৪টি গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছে। রাখাইনের বুচিডংয়ের রইচ্ছংপাড়া থেকে সপরিবারে আসা আশরাফ আলী (৪০) ও তার স্ত্রী আয়েশা বিবি’র (৩৫) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পালিয়ে আসা অন্যদের মতো তারাও মংডুর সর্বদক্ষিণে নাইক্ষংদিয়ায় অবস্থান করছিল তিন দিন ধরে। বুচিডং এর নাইচাদং, কুমাংচিদং, কোয়াংছিবং, নাগপুরা, চিনদং, কাউয়ারখোপ, লাউদং, নয়াপাড়াসহ ১৪টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গত সোমবার ভোর রাতে আনজুমানপাড়া শূন্য রেখায় পৌঁছায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত তিনদিন ধরে নাফ নদীর আনজুমানপাড়ার বেড়িবাঁধ, ধানক্ষেত ও চিংড়ি ঘেরে দিনের বেলা রোদে পুড়ছে রোহিঙ্গারা। আবার গতকাল বুধবার দুপুরের হঠাত্ বৃষ্টিতে তারা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহায়। তার ওপর এসব দুর্ভোগের ফলে অনেক শিশু ও বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
এ ব্যাপারে সেখানে কর্মরত বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা আনুষ্ঠানিক কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগসহ বেশকিছু দাতা সংস্থা ত্রাণ ও চিকিত্সা তত্পরতা অব্যাহত রেখেছে।
সেখানে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থার একজন প্রতিনিধি বলেন, আগে পরে বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দিবে। সেক্ষেত্রে এখানে তাদের আটকে রেখে অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি।
কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ পর্যন্ত এইডস রোগীর সংখ্যা ৩৩ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে ১৮ জন নারী, ১০ পুরুষ এবং ৫ জন শিশু। এ পর্যন্ত একজনের মৃত্যু হলেও বাকিরা চিকিত্সাধীন। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. মো. শাহীন আবদুর রহমান বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ৩৩ জনের ২২ জন মিয়ানমার থাকাকালীন শরীরে এ ভাইরাস শনাক্ত করেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ক্যাম্পগুলোতে ৩৫ হাজার ল্যাট্রিন প্রয়োজন। ইতোমধ্যে ১০ হাজারের বেশি নির্মাণ করা হয়েছে। সরকার এবং দেশি-বিদেশি এনজিও বাকি ল্যাট্রিন নির্মাণে কাজ করছে। বিদ্যুতায়নের আওতায় আনা হয়েছে পুরো ক্যাম্প। চন্দনাইশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসা রোহিঙ্গারা দলে দলে ছুটছে কক্সবাজারে। মূলত দেশি ও বিদেশি ত্রাণ পাওয়ার আশায় তারা সেখানে ছুটছে।
জানা গেছে, উপজেলার দোহাজারী, হাশিমপুর, কাঞ্চনাবাদ, এলাহাবাদ, জঙ্গল জামিজুরী, হাতিয়াখোলা, উত্তর মাস্টারঘোনা ও ধোপাছড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিল। প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা ছিল সেখানে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নগদ অর্থ, চাল, ডাল, কাপড়-চোপড়, প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে- এই খবরে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো কক্সবাজারে ছুটছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ