স্বাস্থ্য ডেস্ক:
আজ বিশ্ব হস্পিক এবং পেলিয়েটিভ কেয়ার দিবস। এ দিবসের এবারের স্লোগান হচ্ছে– “সার্বজনীন স্বাস্থ্যে পেলিয়েটিভ কেয়ার নিশ্চিত করা, যারা রোগে ভুগছে তাদের ত্যাগ না করা”। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলদেশেও এই দিবস উদযাপিত হয়। তবে উন্নত দেশে খুব পরিচিত বিষয় হলেও আমাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে এই পেলিয়েটিভ কেয়ার সম্বন্ধে ধারণা খুব কম।
পেলিয়েটিভ কেয়ার কী?
সহজভাবে বলতে গেলে– এটা এমন একটি বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা। যখন একজন মানুষ দুরারোগ্য ব্যধিতে (যেমন- ক্যানসার, এইডস, হৃদযন্ত্র জনিত রোগ , আলঝেইমার , পারকিনসন, মোটর নিউরন ইত্যাদি) আক্রান্ত হন, তখন তিনি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে বিভিন্ন চাপের মুখোমুখি হন। এই চাপ যতদূর সম্ভব কমিয়ে তার অর্থপূর্ণ জীবনে উন্নিত করার লক্ষ্যে যে সেবা দেওয়া হয় তাকে পেলিয়েটিভ কেয়ার বলে। আর হস্পিক কেয়ার হচ্ছে রোগীর অবস্থা যদি এমন হয় যে ওষুধ দিয়ে আর তার কাজ হবে না বা ছয় মাস বা এর কম দিন বাঁচবেন বলে মনে হয়, তখন হস্পিককেয়ার (পেলিয়েটিভ কেয়ার এর একটি বিশেষ সেবা) এ রাখা হয় ।
দুরারোগ্য রোগের কারণে মানুষ মৃত্যুর ক্ষণ গণনা শুরু করে। সুস্থ হওয়ার আশা প্রায় ছেড়ে দেয়। তাই রোগ নির্ণয়ের পর থেকেই এই বিশেষ সেবার প্রয়োজন হয়। একজন রোগী শারীরিক ব্যথা , ক্লান্তি , ক্ষুধা, বমিবমি ভাব, শ্বাস প্রশ্বাস সমস্যা, অনিদ্রা, মানসিক (বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং ভয়),ব্যবহারিক (আর্থিক সমস্যা, চাকরিজনিত চিন্তা, গচ্ছিত টাকা সম্পদ নিয়ে চিন্তা ), আধ্যাত্মিক (খারাপ ধারণা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়া) ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হয়। যার ফলে তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম সঠিকভাবে করতে পারে না । তখন সে পরিবারের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে করে পরিবারও বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়।
অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, চিকিৎসক, সেবিকা, সমাজকর্মী এবং নিবন্ধনযুক্ত স্বাস্থ্য সেবাদানকারী পেশাজীবীরা দলগতভাবে এই বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। অকুপেশনাল থেরাপিস্ট তার সেবার মাধ্যমে একজন রোগীকে যতদূর সম্ভব শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী দৈনন্দিন কাজে যেমন- খাওয়া দাওয়া, গোসলকরা, প্রসাব-পায়খানা করা,কাপড় পরা, নামাজ কালাম পড়া, অবসর সময় কাটানো, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি, শারীরিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে খাপ খেয়ে নিতে সাহায্য করা ইত্যাদি কাজে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
পেলিয়েটিভ কেয়ারে অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকাগুলো হল-
পোশাক পরিধান করার ক্ষেত্রে: একজন রোগী যাতে তার পোশাক পরিচ্ছেদ নিজে নিজে পরতে পারেন তার জন্য মোডিফাইড বা অভিযোজিত সরঞ্জাম, কৌশল এবং রোগীর শরীরের ওপর অধিক চাপ যাতে না লাগে বা শক্তি ক্ষয় কম হয় সে দিকটা শেখানো।
গোসল করার ক্ষেত্রে: রোগী যাতে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থেকে কম শক্তি ক্ষয় করে গোসল এবং প্রাকৃতিক কাজ সারতে পারেন সে দিকটা খেয়াল করা এবং সাহায্যকারী সরঞ্জাম, হাতল বা বেঞ্চের সহায়তা করা।
চলাচলের ক্ষেত্রে: রোগী যাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে না পড়ে, রোগীর কাজ কর্মের চলাচলের পরিবেশ নিরাপদ এবং ঝুঁকিমুক্ত থাকে সে জন্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখার দিকটা খেয়াল করে থাকেন। আর চলাচলের ক্ষেত্রে কোন সরঞ্জাম ব্যবহার হলে সেটা যেন নিরাপদ, আরামদায়ক এবং চাপ মুক্ত থাকে যাতে চাপ জনিত ঘায়ের কোন সম্ভাবনা না থাকে সে দিকটাও বিশেষ ভাবে বিবেচনা করে থাকেন।
খাদ্য প্রস্তুত করনে: রান্না করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সরঞ্জাম যাতে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায় সেভাবে রান্না ঘর পুনর্গঠিত করা এবং রোগীর স্বাস্থ্য উপযোগী খাবার তৈরির ক্ষেত্রে দৈনিক পুষ্টিকর মানসম্পন্ন খাবার তালিকা যাতে মেনে চলে সে দিকে উৎসাহ প্রদান ।
গৃহস্থালির কাজ কর্মে: কাজ যদি শারীরিক সক্ষমতা অনুযায়ী সহনশীল হয় যেমন- ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় পরিষ্কার করা তাহলে সে ক্ষেত্রে উৎসাহিত করা । প্রয়জনে মোডিফাইড সরঞ্জাম, সহায়তা, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে দেয়া ।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা: কাজের সময় ক্লান্তি, ব্যথা, উদ্বেগ বা শাসকষ্টজনিত উপসর্গ প্রশমিত করতে কৌশল শেখানো ।
ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কার্যক্রম: পছন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পরিচালনা করা ।
বিশ্রাম এবং ঘুম: অভ্যাস অনুযায়ী ঘুমানো ও জেগে থাকার সময় মূল্যায়ন করা। সেই অনুযায়ী তালিকা প্রণয়ন করা যাতে রোগী কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বা মানসিক চাপে না পরে। চাপ থেকে ত্বকের ভাঙন কমাতে , বিশ্রাম করার সামর্থ্য বাড়াতে বিভিন্ন আরামদায়ক এবং শিথিলিকরণ কৌশল প্রদান করা।
অবসর কাজে অংশগ্রহণ: রোগী যাতে মানসিক চাপ, বিষণ্ণ, উদ্বেগ বা চিন্তা মুক্ত থাকতে পারে তার জন্য অর্থপূর্ণ অবসরকালীন কাজে অংশগ্রহণ করানো এবং এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশল প্রদান করা।
মনসামাজিক এবং চারিত্রিক স্বাস্থ্য: রোগীকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে অংশগ্রহণ করানো এবং সামাজিক সম্পর্ক বাড়াতে তার পরিবারকে উৎসাহিত করা যাতে তার মধ্যে থাকা ভয়, উদ্বেগ এবং নেতিবাচক অনুভূতি প্রশমিত হয়।
এছাড়াও রোগীর শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থান দেখে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট তার সেবার ধরণ যেকোন সময় পরিবর্তন, সংযজন ও পরিমার্জন করে থাকেন।
অকুপেশনাল থেরাপিস্ট কাউন্সিলিং, দলগতভাবে বা পরিবারের সদস্যদের সাথে রেখে সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে রোগীর মনের ভুল ধারণা, দুশ্চিন্তা দূর করে মানসিক সেবা এবং সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। যার ফলে একজন রোগী তার শেষের সময় যতটুকু সম্ভব ভালোভাবে পরিচালিত করতে পারেন। একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সরাসরি নিজে বা স্বেচ্ছাসেবক, পরিবার বা রোগীর সহযোগিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাখতে পারেন।
সুতরাং প্রশমনকারী সেবা (পেলিয়েটিভকেয়ার) খুব প্রয়োজনীয় একটি সেবা যা দূরারোগ্য রোগীদের জীবনের শেষ পর্যায়ে অনেক সহযোগিতা করে থাকে আর এ ক্ষেত্রে অকুপেশনাল থেরাপি চিকিৎসা সেবার ভূমিকা অগ্রগণ্য।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি