নিজস্ব প্রতিবেদক:
পুব আকাশে তখনো ঠিক স্বচ্ছ সূর্য উঠেনি, ঝাপসা ঝিকিমিকি সূর্যের আলোতে জুমক্ষেতে জুমের ফলন তুলছেন পাহাড়ি নারীরা। ধানের চড়া নিড়ে তুলে নিচ্ছেন পিঠের উপর রাখা ঝুড়িতে (হাল্লোং-চাকমা ভাষায়)। প্রতিবছরই জুমের মৌসুমে ভোরবেলা থেকেই জুমের ফসল তোলেন নারীরা।
সবেমাত্র সবুজ পাহাড়ের জুমক্ষেতে শুরু হয়েছে পাকা ধান কাটার উৎসব। পাহাড়িরা উৎফুল্ল মনে ব্যস্ত জুমের পাকা ধান কাটতে। জুমিয়াদের ঘরে উঠছে জুমের সেই সোনালি ফসল। এ যেন জুম কাটার ধুম। একই সঙ্গে ধুম পড়েছে মারফা, বেগুন, মরিচ, ঢেঁড়স, কাকরোল, কুমড়াসহ বিভিন্ন জুমের ফসল তোলার কাজও। আর এ বছর পার্বত্যাঞ্চলে জুমের বাম্পার ফলন হওয়াতে উচ্ছ্বাসে ভাসছে পার্বত্যাঞ্চলের জুমিয়া পরিবারগুলো।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রমতে, জুম চাষিরা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালের জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রোদে শুকানোর পর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে জুম চাষের উপযোগী করে তোলে। এরপর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পোড়া জুমের মাটিতে সুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে ধান, মারফা, মিষ্টি কুমড়া, তুলা, তিল, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রকম বীজ বপন করে থাকেন। আর এসব জুমের ধান আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেই পেকে থাকে। তারপর শুরু হয় জুমের ফসল তোলার কাজ। সে সময় মারফা, কাঁচা মরিচ ও ভুট্টা পাওয়া যায়। সব শেষে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে তোলা হবে তুলা, তিল ও যব।
জুমচাষি জলসা চাকমা জানান, জুম চাষযোগ্য পাহাড়গুলোতে বীজ বপনের ৫-৬ মাস রক্ষণাবেক্ষণ করার পর জুমের ফসল দেখা যায়। তবে এবছর জুমের ফলন ভালো হয়েছে। পাহাড় ধসে কিছু জুমেরক্ষেত বিলীন হলেও অন্য জুমের ফলনে আমরা খুশি।তিনি বলেন, এবছর আশানুরূপ ফলন হওয়াতে আশা করছি আমাদের খাদ্য সংকটে ভুগতে হবে না। জুমচাষি সোনালী চাকমা বলেন, এ বছর সময়োপযোগী বৃষ্টিপাত আর জলবায়ু ঠিক থাকায় তেমন কোনো ক্ষতির সম্মুখীন না হয়েই ফসল উঠাতে পেরে আনন্দ লাগছে।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃঞ্চ প্রসাদ মল্লিক বলেন, এ বছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১.৩ মেট্রিকটন। ইতোমধ্যে ৫৮ ভাগ জুম কাটা হয়েছে। যার পরিমাণ ২ হাজার ৬২০ হেক্টর। এ বছর জুমের বাম্পার ফলন হওয়াতে আশা করছি কৃষি বিভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে।
তিনি আরো জানান, রাঙামাটিতে প্রায় ১২ জাতের জুমে ধান চাষ করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে মেরুন, গেলং, রাঙ্গি, কবরক, কামারং, বিনি, আমিং, তুরকি, ছড়ই, সুরি, মধুমালতি ও সোনাই চিকন উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি পরিবারগুলো ঐতিহ্যবাহী জুম চাষ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। যে বছর জুমের ভালো ফলন হয় না তখন অনেকেরই খাদ্য সংকটে ভুগতে হয়, যেমনটি ঘটেছিল এ বছর বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নের জুমিয়া পরিবারগুলোর।
আর জুম চাষ হচ্ছে ঢালু পাহাড়গুলোতে বিশেষ ধরনের চাষাবাদ। জুমিয়ারা পাহাড়ের ঢালে বিশেষ পদ্ধতির এই প্রাচীন জুম চাষাবাদ করে থাকেন। বাংলাদেশের শুধুমাত্র তিন পার্বত্য জেলায়ই এ জুম চাষ করা হয়ে থাকে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ