দেশ জনতা ডেস্ক:
আমরা তো জানি, সন্তানের জন্য বাবা-মা দুজনের সাহচর্যই প্রয়োজন। কিন্তু দুজনের সেই কাজটাই একজন সিঙ্গেল মাদার একাই করে চলেছেন হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, সাহসে বুক বেঁধে। তিনি একাই সন্তানের কাছে হয়ে উঠেছেন বাবা-মা দুই-ই।কাজটা ঠিক সার্কাসে দেখা সরু দড়ির ওপর দিয়ে চলার মতোই কঠিন। তাকে একাই কখনো বাবার মতো কঠোর হয়ে শাসন করতে হয়, আবার মায়ের মতো স্নেহ দিয়ে সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিতে হয়। বাবার মতো সন্তানকে চেনাতে হয় বাইরের দুনিয়া। আবার মায়ের মতো পরিবারের ভেতরকার প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হয়, যাতে সন্তানের মধ্যে তৈরি হয় দায়িত্ববোধ। সিঙ্গেল মাদারদের পদে পদে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়।সিঙ্গেল মাদারদের প্রতিকূল পথচলা* সন্তানের পিতৃপরিচয় বিব্রত করেসন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। কেননা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়, সবখানেই সন্তানের পিতৃপরিচয় তুলে ধরতে হয়। যে মানুষটা কোনো দায়-দায়িত্ব নিলো না, সন্তান মরে গেল নাকি বেঁচে রইল সে নিয়ে যার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তবু তার পরিচয়েই মানুষ করতে হবে সন্তানকে- নির্মম বাস্তবতা! জন্মনিবন্ধনে বাবার নাম চাই, স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় বাবার নাম দাও, ভোটার আইডি কার্ডে বাবার নাম লেখো, চাকরির জন্য তৈরি করা বায়োডাটায়, এমনকি সন্তানের বিয়ের কাবিননামায় অপরিহার্য বাবার নামের সেই মানুষটির পরিচয়। এই নামসর্বস্ব বাবার পরিচয় চিরদিন বহন করে চলতে হয় এমন মায়েদের। এতো কিছুর পরেও আইনি স্বীকৃতি নেই সিঙ্গেল মায়ের। কখনোই তিনি সন্তানের লিগ্যাল অভিভাবক হতে পারবেন না, থাকবেন কেবলেই তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে।
* একা থাকার পথে বাধাএকাকী মায়েরা যখন বাসা ভাড়া নিতে যান, তখন বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই ভাড়া দিতে চান না। এমনকি কেউ কেউ অবমাননাকর মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেন না। একা থাকলে অনেক পুরুষই তখন প্রেম নিবেদন করে বসে। মনে হয়, এ যেন তাদের অধিকার। কেউ কেউ অরুচিকর প্রস্তাব দিতেও কুণ্ঠা করে না। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারপরও এসব একক মায়ের পথচলা থামে না।
* ব্যক্তিগত জীবন আলোচনার বিষয়একাকী মায়েদের ব্যক্তিগত জীবন অনেকের কাছেই হয়ে ওঠে মুখরোচক আলোচনার বিষয়। সমাজের বাতাসে ভেসে বেড়ায় হাজারো প্রশ্ন- কেন ডিভোর্স হলো? কী ঘটেছিল? কার দোষ ছিল? প্রাক্তন স্বামী এখন কোথায়? বিয়ে করেছে কি না? আরো কতশত প্রশ্ন! তা পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশীই হোক, অফিসের সহকর্মীই হোক, সন্তানের বন্ধুদের বাবা-মা হোক। কেউ কেউ আবার এসব প্রশ্ন সরাসরি মায়েদের করেও ফেলেন। এসব বিষয়ই সিঙ্গেল মায়েদের মোকাবেলা করতে হয় মনের জোর নিয়ে।কখনো কখনো ঘর ও বাইরের দায়িত্ব দুটোই একা হাতে সামলাতে গিয়ে সন্তানকে খানিকটা বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেন সিঙ্গেল মাদার। কিংবা আবার কখনো কখনো তেমন খেয়াল রাখতে পারেন না সন্তানের মনোজগতের পরিবর্তনের দিকে। অর্থাৎ রাশ বেশি আলগা বা বেশি কঠিন হয়ে পড়ার দুরকম আশঙ্কাই থেকে যায় একাকী মায়ের ক্ষেত্রে। আবার যে সন্তানের জন্যই এতোকিছু সেই সন্তানই মাকে কখনো ভুল বুঝে ফেলে।তাই সন্তান লালন-পালনের সময় এমন মায়েরা নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে কাজটা হয়তো একটু সহজ হবে-
* ছোট থেকেই সন্তানকে আপনার একাকিত্ব, সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ বুঝতে দিন। দেখবেন ধীরে ধীরে সেও আপনার সহমর্মী হয়ে উঠবে।
* সন্তানের কাছে নিজের অবস্থানটা সব সময় পরিষ্কার রাখুন। সারাক্ষণ ওর সামনে বাবাকে দোষারোপ করবেন না। কে ঠিক বা কে ভুল সেটা ওকেই বুঝে নিতে দিন।
* আপনার প্রতিটি আচরণের যুক্তি ও উদ্দেশ্য যেন আপনার সন্তান বুঝতে পারে এবং সেটাকে সম্মান করতে পারে।
* প্রথম থেকেই চেষ্টা করুন সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করার।
* খেয়াল রাখবেন আপনার সম্পর্কে ওর মধ্যে যেন অকারণে কোনো ভুল বোঝাবুঝির না সৃষ্টি হয়।
* সন্তানকে শুধু শাসন বা শুধুই প্রশ্রয় নয়। আচরণে একটা ভারসাম্য রাখুন।
* আপনি ওকে স্নেহ-মমতায় ঘিরে নিরাপদে রাখুন, তবে নির্ভরশীল বা মুখাপেক্ষী করে রাখবেন না। ওর যেন স্বাধীন চিন্তা, মতামত ও সৎসাহস গড়ে ওঠে।
* সিঙ্গেল মাদাররা অনেক সময় নিজেরাই সন্তানদের ব্যাপারে অনিরাপত্তায় ভোগেন। সন্তানদের আঁকড়ে রাখা এর অন্যতম লক্ষণ। সন্তানের প্রতি টান এবং ভালোবাসা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সেটা যেন কখনোই পজেসিভনেসে পরিণত না হয়।
একক অর্থাৎ সিঙ্গেল মায়েরা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করেন। সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে একাই বড় করে তুলতে হয় সন্তানকে। সিঙ্গেল মায়েদের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য দিতে হয় অনেক মানসিক ও কায়িক শ্রম, দেখা না-দেখা ত্যাগ-তিতিক্ষা। এ জীবন কতটা কষ্টসাধ্য- তা কেবল সেই নারীই জানেন। মা দিবসে সেইসব মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
n/h =ddj