শিল্প–সাহিত্য ডেস্ক:
রাত দু’টোর সময় অর্ধেক চাঁদ উঠেছে। চন্দ্রমাসের হিসাব আজকাল কেউ রাখে না। কী দরকার হিসাবের! সময় মতো সবকিছুই তো জানা যাচ্ছে, দিন আর সময়গুলোও পার হচ্ছে। বেশ কিছুকালই তো হয়ে গেলো নিশাচর প্রাণীর মতো জেগে থাকার অভ্যাস। মাঝেমধ্যে মনে হয় নাইট গার্ডের একটা চাকরি জুটলেই ভালো হতো। রাস্তা দিয়ে পায়চারী আর কিছুক্ষণ পর পর পি পি করে বাসি বাজানো।
নীলা অঘোরে ঘুমোচ্ছে, বেচারি কোনোমতে রাতের খাবারটা শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই হয়। সাত বছরের সংসার জীবনে সাতাশ দিন সুখ দুঃখের গল্প হয়েছে কি না হিসাব করে বলতে হবে।
মারুফ জানালা দিয়ে চাঁদ টা দেখে। সুন্দর লাগছে। কয়েকটা মেহগনি গাছের উপর থেকে উঁকি দেয়া চাঁদ দেখে মনে হয় গাছের উপর লাইট জ্বালানো। আলোর তীব্রতা অতোটা প্রখর না হলেও চারদিকে চারটা চাঁদ উঠলে স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটের মতো মনে হতো, যদিও সে সম্ভাবনা নেই আর চারটা চাঁদ উঠলেই বাড়ির পাশের ছোট্ট মেহগুনি বাগানে খেলা শুরু হয়ে যাবে না। মারুফের ইচ্ছে করে চাদের মিষ্টি আলোয় স্নান করতে। ছাদে গিয়ে দাঁড়াবে, আবছা আলো আঁধারি মিলিয়ে দেখা যাবে অনেক দূর। মনের কোনে দোলা দেয় আরাকানের আকাশটা দেখা যাবে কি! না, যাবে না হয়তো। সে অনেক দূর। আকাশটা বড় বিষন্ন। দিন-রাতের ঘর বাড়ি পোড়া ধোয়ার সাক্ষী। কোনোকালে কোনো বাতাস এতো মানুষের আহাজারি, মানুষ পোড়া গন্ধ বয়েছে কি না কে জানে!
মারুফ আস্তে করে মশারি উঁচু করে বের হয়। নীলা হাঁসফাঁস করে নড়ে ওঠে, কিছুক্ষণ পরপরই এমন করে। কেন করে কে জানে! সংখ্যাটা খাতায় লিখে রাখতে পারলে ভালো হতো। কতো কিছুই তো লিখে রাখতে ইচ্ছে করে, লেখা হয় না। কেন লিখবে! বুকের কথা গুলো না হয় বুকের ভেতর চাপাই থাক।
– এই যে স্যার অফিসে যেতে হবে না! নীলার ডাকে ঘুম ভাঙে।
আকাশের সূর্যটা বেশ কড়া আলো বিলাচ্ছে।রাতে চাঁদ তার স্নিগ্ধ আলোয় কখন যে মারুফকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় মনে করতে পারে না।
-হ্যাঁ, যেতে হবে।
– ছাদে ঘুমানো খুব ভালো, তবে চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গু যদি ধরে আমি কিন্তু সোজা বাপের বাড়ি চলে যাবো। তোমারটা তুমি বুঝবে।
– হ্যাঁ নীলা, পৃথিবীতে আজকাল আপন বোঝা মানুষগুলো কিলবিল করছে।
– মানে!
– কিছু না।
মারুফ তড়িঘড়ি নিচে নামে। দশটা বেজে গেছে। দ্রুত রেডি হয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ায়। নীলা পেছন থেকে বলে-খাবে না।
– না, সময় নেই। নীলার কী উত্তর সেটা যেমন শোনা হয় না, শুনতে ইচ্ছেও করে না। অফিস থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যা গড়ায়। মাঝে মাঝে ফেরার পথে মহল্লার গনি মিয়ার ছোট্ট চায়ের দোকানটা তে গিয়ে বসে। আগে যেত নামকরা চা কফির দোকান গ্রিন ক্যাফেতে। যেদিন পেপারে উঠলো ওখানে টিস্যু পেপার দিয়ে দুধের সর বানানো হয় তারপর থেকে আর যায়নি। দোকানে ঢুকতে প্রথম চেয়াটাতেই বসে আছেন মহল্লার প্রবীণ মুরব্বি হারুন চাচা। পায়ের উপর পা দিয়ে বসে পনের মিনিটের বিরতিতে একবার চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন।
মনোযোগ টেলিভিশনের দিকে।
-চাচা কী খান!
-কেন চা খাই, লাল চা দেখা যাচ্ছে না?
– যাচ্ছে তো।
– তাইলে আবার কী জিগাও!
– মানে, চা ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগে কি না সেটা আসলে আমার জানা নেই!
– আরে মিয়া এখানে কি চা খাওয়া নাকি, চার টাকায় আটটা সিরিয়াল। পঞ্চাশ পয়সা তো নাই, থাকলেও পঞ্চাশ পয়সায় কিছু হয়?
– না, হয় না। চাচা।
-বলো।
-আজও আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার, অবশ্য বাংলাদেশ তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
হারুন চাচা একটু ক্ষেপে ওঠেন।
-বয়স হয়েছে বলে তামাশা করো?
– তামাশা মানে! মারুফ অবাক হয়।
– হেরা মানুষেরে মারতাছে এইডা মানলাম, তাই বলে যা কইবে হেইডা মানমু, আমি কি পাগল?
– না, না আপনি পাগল হবেন কেন।
– তাইলে আকাশসীমা লঙ্ঘনের কথা কইলা ক্যা! আকাশের কোনো সীমা আছে?
– না নেই।
– ছোটকাল থেইক্যাই জানি আকাশের কোনো সীমা নেই, ধরলাম তোমার কথাই ঠিক, যদি সত্যিই মিয়ানমার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে ফেরেশতারা কি বসে থাকবো!
– এ সীমা সে সীমা নয় চাচা।
– তয় কোন সীমা! নায়ক আকাশ আর নায়িকা সীমা?
মারুফ কথা বলে না, চুপ করে থাকে। বাড়ির পথ ধরে হাঁটে। দোকান ভরা মানুষগুলো চা খায়, সিরিয়াল দেখে। যুবক-বৃদ্ধ। মারুফ বিড়বিড় করে বলে একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছো বলে স্বাধীনতার মর্মটাই ভুলে গেলে! ভুলে গেলে দেশপ্রেম! নেশার মোহ তখনি ভাঙে যখন পাছার উপর লাথি পড়ে। রাতের আকাশে এদিক ওদিক কালো মেঘের স্তুপ। আকাশটা ভীষণ কালো।
মারুফের খুব ভয় হয়, স্বাধীন সোনার দেশটার উপর কালো কালো মেঘ জমছে। শকুনের আনাগোনা আকাশে। পিশাচের দল কি ষোল কোটি সাধারন মানুষের রক্তের গন্ধ শুকছে, না পেয়েছে! তীব্র বৃষ্টিতে ফসল তলায়, ঘর বাড়ি ডোবে, মানুষ আপন ঘর ছেড়ে আশ্রয় খোঁজে, বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়েছে। মানুষও তো আকাশ কালো করে, কালো কালো ধোঁয়ায় ভরা আকাশ। আকাশ থেকে বিকট শব্দ ও আগুনের ঝলকানিতে বিপন্ন মানুষ ও মানবতা। ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষ পালায় জীবনের তাগিদে, জীবন বাঁচাতে। ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামে, আলোর ঝলকানি। গুড়ুম গুড়ুম বিকট শব্দের মেঘের ডাক কী বলে কে জানে? মারুফ কালো আকাশ, বৃষ্টি আর বিজলি নিয়ে হেঁটে চলে।
লেখক: গল্পকার