২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:০৫

মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক যাত্রা আবারও হোঁচট খাচ্ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

মিয়ানমারের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের জন্য বর্তমানে কঠিন সময় চলছে। দেশটির ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবনেই যে শুধু সঙ্কট দেখা দিয়েছে তাই নয়; বরং কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা ও রোহিঙ্গা সঙ্কট ঘিরে আবারো বিশ্বের সবচেয়ে নবীন গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

৫০ বছরের সামরিক শাসন থেকে বেরিয়ে মিয়ানমার বর্তমানে দেশের ভেতরে এবং বাইরের নতুন শত্রুর সঙ্গে পুরনো শত্রুকে মোকাবেলা করছে। এর শুরু হয়েছে রাখাইনে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সমন্বিত হামলা ও সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন অভিযানের পর। উত্তর রাখাইনে ব্যাপক সংঘাত শুরু হয়েছে।

গণতান্ত্রিক রূপান্তরে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) ১৮ মাসের ক্ষমতায় অনেক শত্রুকে মোকাবেলা করছে। গত বছরের মার্চে এনএলডি’র ক্ষমতায় আরোহনের মাধ্যমে মিয়ানমারের পাঁচ দশকের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।

এর আগে দেশটির ক্ষমতায় ছিল সামরিক জান্তা নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি। গণতান্ত্রিক যাত্রায় এটা মনে হচ্ছে যে, দেশটির বেসামরিক সরকারের পাশে নেই শক্তিশালী সামরিক সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ হচ্ছে, ২০০৮ সালের অগণতান্ত্রিক সংবিধান রক্ষা করা। তবে মিয়ানমার সরকার এই সংবিধানে সংশোধনী আনার অঙ্গীকার করেছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী এবং সরকারের প্রধান রাজনৈতিক কাজ হচ্ছে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়া। এটাই এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক যাত্রায় মিয়ানমারের মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নিরাপত্তাবাহিনীর ৩০টি তল্লাশি চৌকিতে আরসার হামলার পর এনএলডির সামনে আরো বেশ কিছু শত্রু হাজির হয়েছে। আরসাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে তাৎক্ষণিকভাবে হামলার নিন্দা জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার।

রাখাইনের অস্থিতিশীলতায় দেশটির অনেকেই এখন উদ্বিগ্ন। সংঘাতের একতরফা চিত্র উঠে আসছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। এই সংঘাতের ফলে দেশটির সামরিক শাসনের অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায় আবারো ফিরে আসতে পারে; যা ১৯৬২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ দশক মিয়ানমারের জনগণ সহ্য করেছে। তবে সেই সময়ের সুবিধাবাদীরা ছাড়া কেউই চায় না এই দুঃস্বপ্ন আবার ফিরে আসুক।

১৯৬২ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে ১৯৯০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় এনএলডি জয়ী হলেও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। তৎকালীন সেনাশাসিত সরকার এনএলডির প্রধান সু চিকে গৃহবন্দী করে রাখে। দীর্ঘদিন পর ২০১০ সালে গৃহবন্দী থেকে মুক্তি পান মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী এ নেত্রী । গত বছরের নির্বাচনে বড় ধরনের জয় পায় সু চির দল।

মিয়ানমারের নতুন বেসামরিক সরকারের অভ্যন্তরীণ শত্রুরা আবারো ফিরে আসার সুযোগের অপেক্ষায় আছে। যদি ভয়াবহ এই ঘটনা বাস্তবে ফিরে আসে তাহলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে চ্যাম্পিয়ন এক গণতন্ত্রের ধ্বংস দেখবে বিশ্ব। যেখানে শাসক, সেনাবাহিনী ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে অনেক দেশের সম্পর্ক আছে।

এটি সারা বিশ্বজুড়ে তোলপাড় ফেলবে; যেখানে পশ্চিমাবিরোধী রাশিয়ার নেতা পুতিন এবং তুরস্কের এরদোয়ানের মতো নেতাদের জনপ্রিয়তা তাদের দেশে বেড়ে চলছে। উত্তর রাখাইনে নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে; লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়েছে। মংডুর অনেক বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত হয়েছে।

যতদ্রুত সম্ভব রাখাইনের সংঘাত থামানো দরকার। এছাড়া বেসামরিকদের বিরুদ্ধে যারা নৃশংস কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশন ও সংঘাতে পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান মিয়ানমারকে বৌদ্ধসংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারকে একটি প্রতিকূল জাতি হিসেবে তুলে ধরছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মারাত্মক জাতীয়তাবাদী হিসেবে বৌদ্ধদেরকে সংবাদের শিরোনামে আনতে কোনো ধরনের দ্বিধা করছে না। এছাড়া মিয়ানমার ‘একুশ শতকের বর্ণবাদের আঁতুরঘর’ হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে।

রাখাইনের গ্রামে গ্রামে আগুন ও বেসামরিকদের হত্যার ঘটনায় দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চিকেও তুলোধুনা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। এর কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রতি তিনি কোনো ধরনের সহানুভূতি দেখাননি এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী যে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন পরিচালনা করছে সেটিরও নিন্দা জানানি সু চি।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস গত ৯ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে বলছে, সু চির নেতৃত্বে জাতিগত নিধন অভিযান চলছে। যেখানে গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ ও শিশুদের কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। রাখাইনে নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযান ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় শরণার্থীদের ঢল নেমেছে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে নৃশংস হিসেবে উল্লেখ করে জাতিগত নিধন হিসেবে মন্তব্য করেছে।

১৫ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে ‘অং সান সু চি, ইতর বিজয়ী’। এর ঠিক পরের দিনই ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ ‘অং সান সু চি : বার্মিজ সেনাবন্দী অথবা দানব?’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের আরেক প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট সু চির জীবনী লেখক পিটার পপহামের মন্তব্য প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, ‘সু চির একজন জীবনী লেখক হিসেবে আমি বলতে চাই যে, সু চি এই মুহূর্তে যে ভালো কাজটি করতে পারেন সেটি হচ্ছে এখনই পদত্যাগ।’

শুধু তাই নয়, অনেক সংগঠন ও পশ্চিমারা অং সান সু চির নিন্দা জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের বৃহৎ বাণিজ্যিক ইউনিয়ন ইউনিসন গৃহবন্দী থাকাকালীন সু চিকে যে পুরস্কার দিয়েছিল তা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের শিক্ষার্থীদের সংগঠন বলছে, সু চিকে দেয়া সম্মানজনক পদক তারা ফিরিয়ে নেবেন। পশ্চিমের অনেক মানুষ এমনকি বিভিন্ন সংগঠনও সু চির শান্তির নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নেয়ার দাবি তুলেছে।

মিয়ানমার এখনো গণতন্ত্র বনাম সামরিক একনায়কতন্ত্রের মূল লড়াইয়ে নিয়োজিত আছে। এটি এখনো শেষ হয়নি। অতীত সামরিক শাসকদের সাঙ্গ-পাঙ্গ এবং তাদের মিত্ররা ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। এই লড়াইয়ের অবসান ঘটতে পারে কেবল অগণতান্ত্রিক সংবিধানের সংশোধনীর পর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে।

মৌলিক এই লড়াইয়ে অক্ষমতা এবং দুর্বলতা সত্ত্বেও দেশটির অনেক মানুষের সমর্থন এখনো সু চি ও তার সরকারের প্রতি রয়েছে। কারণ তারা উপলব্ধি করতে পারছেন যে, এটি সহজ কাজ নয়।

সম্প্রতি মিয়ানমার একটি রূপান্তরের শুরুর ধাপে রয়েছে, কয়েক দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসকের রেখে যাওয়া সমস্যা সমাধান করছে। একই সঙ্গে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে লড়াই করছে।

রোহিঙ্গাদের মতো জনগোষ্ঠীর জন্য, যাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং দীর্ঘকাল ধরে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন; একমাত্র গণতান্ত্রিক সরকারই পারে তাদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে।

রাখাইন সঙ্কটের সমাধানে মিয়ানমার সরবার জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর বিরোধিতা সত্ত্বেও এ ঘোষণা এসেছে। তবে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ঠিক কতদিন সময় লাগতে পারে সে ব্যাপারে দেশটির সরকার পরিষ্কার কোনো তথ্য জানায়নি।

রাখাইনের এই অস্থিতিশীলতা এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের কারণে দেশটির নির্বাচতি বেসামরিক সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এর ফলে গণতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দলে যে শূন্যতা তৈরি হবে তা পূরণ করার মতো কেউই থাকবে না। শুধুমাত্র সেনাবাহিনী এবং এবং তাদের মিত্ররাই অবশিষ্ট থাকবে।

বর্তমানে পরিস্থিতিতে পুরনো শাসক এবং তাদের মিত্ররা ছাড়া প্রত্যেকেই তাদের আশা হারিয়ে ফেলছেন। সেনাবাহিনীর বুটের নিচে বিশ্বের নবীন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যাত্রা ধ্বংস হবে এবং মিয়ানমারের জনগণ আবারো একই ধরনের ভোগান্তির শিকার হবে। সংক্ষেপিত।

মিয়ানমারের ইংরেজি দৈনিক দ্য ইরাবতি অনলাইন অবলম্বনে।

দৈনিক দেশজনতা /এনএইচ

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৭ ৮:২২ অপরাহ্ণ