২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৮:০২

অবশেষে মতিন সরকারের আত্মসমর্পণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

অবশেষে আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন বগুড়ার শহর যুবলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিন সরকার। বুধবার বেলা ১২টায় বগুড়া জেলা ও দায়রা জজ আদাল-১ এ উপস্থিত হয়ে তিনি জামিনের আবেদন করেন। বিচারক এমদাদুল হক তার আবেদন শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

২০০৯ সালে চকসূত্রাপুরে আবু নাসের ওরফে মুন্সি উজ্জ্বল হত্যা মামলায় মতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। কিন্তু প্রতাপের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘুড়ে বেড়ানো মতিন সরকার পুলিশের চোখে পালাতক  ছিল দীর্ঘ ৯ বছর। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা আছে। এসব মামলার মধ্যে আটটিতে তিনি জামিনে ছিলেন।

যেভাবে আলোচনায় আসেন মতিন সরকার

চলতি বছরের ১৭ জুলাই তার ছোট ভাই শহর শ্রমিক লীগের বহিষ্কৃত সভাপতি  তুফান সরকার কলেজে ভর্তি করে দেওয়ার কথা বলে এক কিশোরীকে বাসায় ডেকে নেয়। এরপর দিনভর তাকে আটকে রেখে কয়েক দফা ধর্ষণ করে। এতে ওই কিশোরী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে  চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনাটি ওই কিশোরীর মা জানতে পারে এবং বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে তুফান সরকারের স্ত্রীর কানে যায়। এরপর তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন তার বড় বোন পৌরসভার সংরক্ষিত আসনের  নারী কাউন্সিলর  মারজিয়া হাসান রুমকি এবং তার মা রুমী বেগম ওই ধর্ষিতা এবং তার মায়ের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। পরে তাদের দুই জনের মাথা ন্যাড়া করে দেয়। এই ঘটনা প্রথমে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মাঝে জানাজানি হলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহরব্যাপী। ওই ঘটনায় তুফানকে সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে তোলার তীর মতিনের দিকে আসে। গণমাধ্যমে তার সম্পর্কে এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি হয়। ফলে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে ১ অক্টোবর তাকে বহিষ্কার করা হয়।

যেসব চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি

আদাল ও পুলিশের তথ্য অনুসারে, মতিনের নামে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। ১৯৯৮ সালে বগুড়া শহরের নুরানী মোড় এলাকায় রসুল, ২০০৯ সালে চকসূত্রাপুরে আবু নাসের উজ্জ্বল, ২০১১ সালে মাটিডালি এলাকায় বাণিজ্য মেলা চলাকালিন শফিক চৌধুরী এবং ২০১৫ সালে চকসূত্রাপুরে আলোচিত এমরান হত্যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, মতিন আট বছর ধরে পলাতক ছিল। একটি খুনের মামলায় তার বিরুদ্ধে ২০ বারের বেশি পরোয়ানা জারি হয়েছে। পলাতক হিসেবে তার নাম-ঠিকানা দিয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছিল আদালত। মালামাল ক্রোকের পরোয়ানাও জারি হয়। শেষ পর্যন্ত তার ‘অনুপস্থিতিতে’ই মামলার বিচার চলছে। এছাড়াও ২০০০ সালের দিকে শহরের নুরানী মোড় এলাকায় সদর ফাঁড়ির টিএসআই তাকে গুলিভর্তি একটি নাইন এমএম পিস্তলসহ গ্রেপ্তার করেন। ২০০৪ সালের দিকে ওই মামলায় তার ২৭ বছর কারাদণ্ড হয়। কিছুদিন জেলে থাকার পর উচ্চ আদালতে মামলাটি স্থগিত হলে তিনি বেরিয়ে আসেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মতিন রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এরপর তিনি সংগঠনকে ব্যবহার করে মাদক, চাঁদাবাজি, জুয়াসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। জায়গা দখলেও তার জুড়ি নেই। এভাবে খুব অল্প সময়ে কোটিপতি হয়ে যান। বর্তমানে তিনি বিলাসবহুল গাড়িতে চলাফেরা করেন। বগুড়া ও ঢাকায় রয়েছে একাধিক বাড়ি বা ফ্ল্যাট।

মতিন কখনোই পলাতক ছিলেন না। বগুড়া শহর এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়েও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। এসব অনুষ্ঠানে তার পাশে বসে থাকতে দেখা গেছে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকেও। মতিন সরকার বগুড়ায় আগত একাধিক মন্ত্রীকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনাও জানিয়েছেন। এরপরেও পুলিশ দফায় দফায় আদালতে তাকে পালতক দেখিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে।

মতিন সরকার বর্তমানে নয়টি মামলার আটটিতে জামিনে আছে। শুধু আবু নাছের ওরফে মুন্সি উজ্জ্বল হত্যা মামলায় তিনি আট বছর ধরে ‘পলাতক’ দেখানো হয়েছে। ওই হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে মতিন সরকার ও নিহত উজ্জ্বল দুজনই অবৈধ কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এসব নিয়ে বিরোধের কারণেই উজ্জ্বলকে খুন করা হয়। এ মামলায় মতিন ও শফিকুলকে গ্রেপ্তার  করা হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে। ওই মামলার আরেক আসামি আবু তালহা ওরফে ঠান্ডু ২০০২ সালের ২০ জানুয়ারি খুন হন। তাকে খুন করে মতিনের সহযোগী। এ মামলার আরেক আসামি শফিকুল। আবু তালহা খুনের মামলায় শফিকুলের যাবজ্জীবন সাজা হয়। সেই থেকে তিনি জেলে আছেন।

প্রতি রাতেই বিচার হতো মতিনের আদালতে

শহরের বিভিন্ন জায়গার সাধারণ মানুষের যে কোনো সমস্যার বিচার করতেন মতিন। এর মধ্যে জমিজমা সংক্রান্ত, মারামারি, চুরি, ছিনতাই, নারী ঘটিত ঘটনা। তিনি এক পক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তার পক্ষেই রায় দিয়ে দিতেন। শহরের একাধিক ব্যক্তি তার অবিচারের শিকার হয়েছেন এমন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, জোর করেই তার সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করা হয় মতিনের বিচারে। তার করে দেওয়া বিচারের বিরুদ্ধে কখনোই কেউ কথা বলেতে পারতো না। প্রতিবাদ করলে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি শহর ছাড়ার করে দেওয়ার ঘটনাও আছে।

তুফান-মতিনের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে অনুমোদন পেল দুদক

দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় বগুড়া সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই মাসের শেষে প্রথমে গণমাধ্যমে তুফান সরকার ও মতিন সরকারের অবৈধ সম্পদের সংবাদ প্রকাশিত হলে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধান (যাচাই বাছাই) শুরু করে। এরপর বগুড়া কার্যালয় থেকে ২ আগস্ট প্রধান কার্যালয়ের মহাপরিচালক (তদন্ত) বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে তাদের সম্পদ অনুসন্ধানের অনুমতি চাওয়া হয়। দুদক বগুড়া কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, সম্পদের তথ্য অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়ে প্রধান কার্যালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছিল। এই পত্রের পর গত ২১ সেপ্টেম্বর আমাদেরকে সম্পদের তথ্য অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তুফান ও মতিন সরকারের সব স্থাবর অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয়া হবে তাদের। হিসাব জমা দিলে সে হিসাবের তদন্ত শেষ করা হবে। এরপর জমা দেয়া হিসাবের সঙ্গে মিল না হলে মামলার অনুমতি চেয়ে প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেয়া হবে। এ ধরনের মামলায় সর্বোচ্চ ১৩ বছরের শাস্তি হতে পারে।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৭ ৩:৪১ অপরাহ্ণ