শরীয়তপুর প্রতিনিধি:
পদ্মায় পানি কমতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে শরীয়তপুরের নড়িয়া, জাজিরা উপজেলা ও সখিপুর থানাধীন চরভাগার এলাকায় পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে অন্তঃত ১৫টি গ্রামের শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে গেছে। ১৫টি গ্রামের গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় সহস্রাধিক পরিবার। তাছাড়া হুমকির মুখে পড়েছে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মূলফৎ বাজার। ভেদরগঞ্জ উপজেলার একটি বাজারের শতাধিক দোকানপাট, রাস্তাঘাট ও আশে পাশের শতশত বসতবাড়ি। ওয়াপদা লঞ্চঘাটে তীব্র স্রোতে ও পদ্মার ভাঙ্গনে ডুবে যাওয়া ৩টি লঞ্চসহ ২০যাত্রী ও স্টাফ নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৮ জনের আজো কোন সন্ধ্যান মেলেনি। ৩টি লঞ্চও উদ্ধার হয়নি।
কুন্ডেরচর চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন ও স্থানীয় জাজিরা ও নড়িয়া প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বরে মাসে প্রথম থেকে পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরভাগা ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত পদ্মার ভাঙ্গনে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কলমির চর কালু বেপারী কান্দি, কায়ুম খার কান্দি,নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি, চেরাগ আলী ব্যাপারী কান্দি, ইউসুফ বেপারী কান্দি কুন্ডেরচর, বিলাশপুর, সাহেদ আলী ব্যাপারী কান্দি, চর নড়িয়া, চরজুজিরা, সাহেবের চর, পাচগাও, সুরেশ্বর, চন্ডিপুর, ওয়াপদা বিলীন হয়ে গেছে শত শত পরিবার।
গত ২০ দিনে পদ্মার ভাঙ্গনে নড়িয়া উপজেলার ওয়াপদা,পাচগাও, জাজিরা উপজেলার কায়ুম খার বাজার ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরভাগা ইউনিয়নের নতুন বাজারের ব্যবসায়ী আলমগীর সরদার, রব মৃধা, সেকান্দার দেওয়ানের, শরীফ আলী দেওয়ান, ফরিদ মাদবর, রতন হাওলাদার, মমিন আলী দেওয়ান ও জসীম সিকদার দোকানসহ প্রায় শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জায়গা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স, নড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, মুলফৎগঞ্জ মাদ্রাসা, মূলফৎ বাজার,নড়িয়া বাজার, নড়িয়া খাদ্যগুদাম, নড়িয়া পোষ্ট অফিস, শত শত সরকারী বে-সরকারী স্থাপনা । এর পাশাপাশি ঐ এলাকার শত শত একর ফসলি জমি ও রাস্তা ঘাট নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানাধীন চরভাগা ইউনিয়নের নতুন বাজারে পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে হুমকির মুখে পড়ে ছোট বড় প্রায় শতাধিক দোকান, বাজারের জামে মসজিদ, রাস্তাঘাট ও আশেপাশের কয়েকটি বসতবাড়ি। ভাঙ্গার বিষয়টি নিয়ে কোন প্রকার পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের। ১১ সেপ্টেম্বর নড়িয়া উপজেলার ওয়াপদা লঞ্চঘাটে তীব্র স্রোতে ও পদ্মার ভাঙ্গনে কারণে ৩টি লঞ্চ মৌচাক-২ , মহানগরী ও নড়িয়া-২ সহ ৫০ যাত্রী ও স্টাফ নিয়ে পদ্মা নদীতে ডুবে যায়। এ সময় কিছু লোকজন সাতরে তীরে উঠতে পারলে ও নিখোঁজ হয়ে যায় প্রায় ২০ জন যাত্রী ও স্টাফ। এরমধ্যে ১ সপ্তাহ অনুসন্ধান করে ৩টি লঞ্চ সনাক্ত করা হলে ও এখনো একটি লঞ্চ ও উদ্ধার করতে পারেনি। শুক্রবার সন্ধ্যায় আকস্মিক ভাবে সাধুর বাজার লঞ্চঘাটটি বিলীন হয়ে যায। এ সময় কমপক্ষে ১০টি দোকান ও পাকা সড়ক নদী গর্ভে হারিয়ে যায়।
গ্রামের জাবেদ আলী বলেন, এ পর্যন্ত পাচঁবার পদ্মা নদীতে ভাঙ্গছে। এরপর আবার নতুন করে জায়গা কিনে ঘরবাড়ী তৈরী করেছিলাম। সে জমি সহ সারা জীবনের স্মৃতি পদ্মায় নিয়ে গেছে। এখনে সবকিছু ফেলে চলে যাচ্ছি অন্যত্র। কোথায় যাব কি করব, কে আমাদের সহায়তা করবে ভেবে পাচ্ছিনা। মোক্তারের চর ইউনিয়নের আতাউর রহমান জানান, দুই একর ফসলি জমি এক একর জমির আমবাগান ও বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। এ সর্বনাশী পদ্মায়।এখন আমি অসহায় জাজিরা উপজেলার কলমির চর এলাকার কালু বেপারী বলেন, ৪ লাখ টাকার মালামালসহ রাতে আমার দোকানটি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুকি নিয়ে বাড়িতে বসবাস করছি। যে কোন সময় বাড়ির অংশটুকুও বিলীন হয়ে যেতে পারে।
ডুবে যাওয়া মৌচাক-২ লঞ্চের দোকানি নিখোঁজ লিটন শেখের স্ত্রী ফাতেমা বেগম সুরেশ্বর পদ্মাপাড়ে স্বামীর ছবি ও কোলের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে স্বজনের লাশের অপেক্ষা আহাজারি করে বলেছেন, গত ১৩ দিন ধরে আমার স্বামীর কোন সন্ধান নেই। ঘটনার দিন রাত ৩টায় সে বাড়ি থেকে লঞ্চে ফিরে আসে এরপর তার আর কোন খোঁজ নেই। আমি আমার স্বামীর লাশটা চাই। ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরভাগা নতুন বাজারের সেলুন মালিক শংকর শীল বলেন, প্রতি বছর নদীর ভাঙ্গনের তীব্রতা কম থাকলেও এ বছর বেশী হওয়ায় অনেকগুলো দোকান ভেঙ্গে গেছে। আমার দোকানও ভেঙে কবলে পাড় রয়েছে। যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে।
স্থানীয় চরভাগা এলাকার বাসিন্দা শামসুল হক প্রধানীয়া বলেন, ধীরেধীরে ভাঙ্গনের ফলে বাজারের সাথে সাথে এ এলাকার ঘরবাড়িও হুমকির মুখে রয়েছে। ভাঙ্গন রোধে শীঘ্রই কোন একটি বেড়িবাধ নির্মাণ করা দরকার। এ বিষয়ে ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল আহমেদ বলেন, নদী ভাঙ্গনে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের তালিকা পুস্তুত করে শীঘ্রই সহায়তা দেয়া হবে। জাজিরা উপজেলা নিবাহী নির্বাহ কর্মকতা রাহেলা রহমত উল্লাহ বলেন, জাজিরা উপজেলায় ভাঙ্গনের ক্ষতিগ্রস্থ ১হাজার ২শ ৭২ জনের তালিকা প্রনয়ন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রতিজনকে ৩ কেজি করে চাল ও নগদ ১ হাজার টাকা বিতরন করা হযেছে। নতুন করে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। তাদের এখনো তালিকা প্রনয়ন করা হয়নি।
জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, লঞ্চডুবির ঘটনায় রাতের কারণে আপাততঃ উদ্ধার অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে। যাদের মরদেহ পাওয়া গেছে তাদের দাফন কাফনের জন্য ৫ হাজার টাকা করে প্রদান করা হবে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি