নিজস্ব প্রতিবেদক:
আমদানি শুল্ক হ্রাস করার পরেও কয়েক দফা চালের দাম বেড়েছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, মানুষ দিন গুণছেন কত টাকা হলে চালের এই দামকে লাগামহীন বলা হবে! এর আগে কখনও এত টাকা কেজি চাল বাংলাদেশের মানুষ খায়নি। মোটা চালও ৫০ থেকে ৬০ টাকায় কিনে খেতে হচ্ছে। মোটামুটি মানের চালের কেজি ৭০ টাকার নিচে নেই। আর এই আকাশ ছোঁয়া চালের দামের জন্য মিল মালিকদের দুষছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। রোববার সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও মিল মালিকদের মজুতদারির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ এসেছে। তবে মিল মালিকেরা মজুত করে চালের দাম বাড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। হঠাৎ করে তারা সরকারের কড়া অবস্থানেরও সমালোচনা করেছেন। ধারাবাহিকভাবেই বিগত কয়েক মাস বাড়ছে চালের দাম। কিন্তু, গত দুই সপ্তাহে এই বৃদ্ধি অস্বাভাবিক হারে ঘটেছে। ক্ষেত্র বিশেষে সব ধরনের চালে বস্তাপ্রতি ৫শ’ টাকার উপরে দর বেড়েছে।
রোববার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ঈদের আগের তুলনায় কমপক্ষে ১০ টাকা বাড়িয়ে খুচরায় কেজিপ্রতি ৬৫-৭০ টাকায় মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া নিম্নবিত্তের মোটা চালও বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, দীর্ঘ ছুটির অজুহাত তুলে ঈদের পর বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৫০ টাকা, ১শ’ টাকা করে কমপক্ষে তিন-চারবার চালের দাম বাড়িয়েছেন মিল মালিকেরা। ফলে এখন প্রতি বস্তা মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১শ’ থেকে ৩ হাজার ২শ’ টাকায়। ভারতীয় স্বর্ণা চাল, বিআর২৮ বস্তাপ্রতি ২ হাজার ৭শ’ থেকে ২ হাজার ৮শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চালের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তেজগাঁওয়ের খায়ের জেনারেল স্টোরের বিক্রয় কর্মী ফরিদ জানান, কাস্টমাররা অভিযোগ করেন, দাম নাকি আমরা বাড়াই। কিন্তু, আমাদেরও বেশি দামে কিনে আনতে হচ্ছে। যেসব মিল মালিকরা দাম বাড়াচ্ছে, সরকার তাদের ধরলেই দাম কমে যাবে। মহাখালী কাঁচাবাজারের হারিস স্টোরের মালিক মিলন মিয়া বলেন, ‘মিল মালিকরা চালের দাম বাড়াচ্ছেন। আমরা বেশি দামে কিনে কমে বিক্রি করব কিভাবে? সরকার হার্ডলাইনে গেলেই চালের দাম কমে যাবে।’ চালের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চাল তো আছেই, না থাকলে মানুষ খায় কি? কিন্তু, ব্যবসায়ীরা কিনতে গেলেই দাম বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এখন চাল কম কিনছি। কারণ এখন বেশি দামে কিনলাম, এরপর দেখা যাবে হঠাৎ দাম কমে যাবে; তখন তো লোকসান দিতে হবে।’
এদিকে, লাগামহীনভাবে চালের দাম বাড়ায় ক্ষুব্দ ক্রেতারাও। তারা মনে করছেন সরকার উদ্যোগী হলে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। মহাখালীতে চাল কিনতে আসা আরজতপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা তানভীর হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঈদের পর চাল কিনতে এসে দেখলাম দাম বেড়ে গেছে। ভাবলাম ক’দিন পর কমে যাবে। কিন্তু, এখন দেখছি আরও বেড়েছে, আমাদের আয় রোজগার তো আর বাড়ে না।’ তিনি বলেন, ‘মানুষ তো ভাত না খেয়ে থাকতে পারবে না। এ জরুরি বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। চাল তো কোথাও না কোথাও আছে, আড়তদার বা মিল মালিকদের ধরলেই সব বেরিয়ে আসবে।’
এদিকে, সরকারের মন্ত্রীরাও চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার পেছনে মিল মালিকদের দুষছেন। রোববার সচিবালয়ে খাদ্যমন্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক করে মিল মালিকদের মজুতদারির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ। চালের দাম বাড়ার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের দায়ী করে তাদের গ্রেপ্তারে ডিসিদের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘জেলার যেখানে রাইস মিল ও গুদাম আছে, সেখানেই অভিযান চালাতে হবে। দেশের যেকোনো স্থানে অস্বাভাবিক পরিমাণ ধান ও চালের মজুত পাওয়া গেলে তা জব্দ করতে হবে। মিল মালিককে গ্রেপ্তার করতে হবে। চাল নিয়ে ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না, এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই।’
বৈঠকেই মন্ত্রী অতিরিক্ত মজুতদারির জন্য বাংলাদেশ রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলীকে গ্রেপ্তার করতে কুষ্টিয়া ও নাটোরের ডিসিদের ফোনে নির্দেশ দেন। পরে রোববার বিকেলে কুষ্টিয়ায় রশিদের চালের গুদামে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু, গুদাম থেকে খালি হাতে ফিরে আসে টাস্কফোর্স। এর আগে বৈঠকে তোফায়েল আহমদ বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াতের লোক এই দু’জনই (রশিদ-লায়েক) ষড়যন্ত্র করে চালের বাজারকে অস্থির করেছে। ভারত চাল রপ্তানি করবে না- দাম বাড়ানোর জন্য এমন গুজব ওরাই ছড়িয়েছেন। দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই। এরাই সরকারকে বিব্রত করতে চালের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।
এদিকে, আগামীকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষেও এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, চালকল মালিক, মিলার, চাল আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করবেন খাদ্যমন্ত্রী। চালের বাজার নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা যা ভাবছি, তা তো টেলিভিশন-পত্রিকায় আসছে। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রীও তো সব বলেছেন। এর বাইরে নতুন কিছু বলার নেই।’ তিনি বলেন, ‘সরকার কঠোর, বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। যেসব অসাধু ব্যক্তি চাল নিয়ে চালবাজি করছেন, তাদের ছাড় দেয়া হবে না।’
তবে চাল বিক্রেতা, ক্রেতা ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সমালোচনার মুখে থাকা মিল মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, তারা পূর্বের দামেই চাল বিক্রি করছেন। মিল মালিকরা বলছেন, মিলে চাল মজুত করে রাখা হলে বাজারে চালের সঙ্কট থাকতো। কিন্তু, সঙ্কট না থাকার পরও চালের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলার জন্য তারা মধ্যস্বত্তভোগীদের দায়ী করছেন। চালের মজুত নিয়ে সরকারের দুই মন্ত্রীর সমালোচনায় পড়া মিল মালিক রশিদ ও লায়েকের গুদাম রয়েছে কুষ্টিয়ায়। এই এলাকার গুদামে অভিযান চালিয়ে এর আগে রশিদকে জরিমানাও করেছিল প্রশাসন।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা চাল কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও স্বর্ণা রাইস মিলের মালিক আব্দুস সামাদ বলেন, ‘চালের সরবরাহ এখন আগের চেয়ে বেশি। আর আমরা ঢাকাতে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৭৫০ টাকায় মিনিকেট চাল পাঠাচ্ছি।’ কুষ্টিয়ার বিভিন্ন মিলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তল্লাশির দিকে ইঙ্গিত করে জেলার পোড়াদহের এই চাল ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা আগের দামেই বিক্রি করছি চাল, এরপরও বাজারে দাম বেশি থাকবে কেন? কারা বাড়াচ্ছে? সেটা বের না করে মিল মালিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’ এর জন্য মধ্যস্বত্তভোগীরা দায়ী জানিয়ে সামাদ বলেন, ‘বাবুবাজার, মোহাম্মদপুর, মিরপুরে গিয়ে দেখেন কোথাও কি চালের কমতি আছে? তাহলে দাম বাড়বে কেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আগে যে অর্ডার নিছি সেটাই এখনও সরবরাহ করছি। আগের অর্ডারে না বেঁচলে তো আমরাও এখন ২ হাজার ৯০০ টাকা বস্তা বিক্রি করতাম।’
তবে দাম বাড়ার পেছনে মিলের দায়ও এড়াতে পারেননি তিনি। আব্দুস সামাদ বলেন, ‘ঈদের দীর্ঘ ছুটির পর মিল চালু হয়েছে। কয়েকদিন উৎপাদন তো একটু কম ছিল। আর কয়েকদিন কাজ চললে বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ হাওরে বন্যা হলে ২০ লাখ টন ফসল নষ্ট হয়। এতে সরকারি মজুতে চালের পরিমাণ কমে যায়। পরে বাজারের অস্থিরতা কমাতে চাল আমদানি শুল্ক ২৬ শতাংশ কমিয়ে দুই শতাংশে নামিয়ে এনে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির চুক্তি করে সরকার।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি