২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:৫৬

বাংলাদেশ সীমান্তে গুপ্তচরদের তৎপরতা বৃদ্ধি, তথ্য পাচারের আশঙ্কা

কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া (কক্সবাজার) :

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢল নামার পর থেকেই সীমান্তে গুপ্তচর তৎপতা বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিয়ানমারের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত পেরিয়ে দলে দলে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে মিয়ানমারের কিছু গুপ্তচর কাজে নেমে পড়েছে।
গত মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকা থেকে তিন জন ও বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) নাইক্ষ্যংছড়ি সদর থেকে একজনকে আটক করে বিজিবি’র সদস্যরা। এর আগে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের দুই সাংবাদিকসহ তিনজনকে এ ধরনের অভিযোগে আটক করা হয়। এরপরই মূলত তথ্যফাঁসের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে গুপ্তচর সন্দেহে আটক করা হয় মিয়ানমারের মংডুর ফকিরাবাজারের বাসিন্দা আব্দুর শুক্কুরের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৪০), মৃত নজির আহমদের ছেলে জাফর আলম (৪৫), নুরে আলমের ছেলে মো. আজমল হোসেন (৪০) ও ইউসুফ আলীর ছেলে মো. কালু মিয়াকে (৬০)। ১২ সেপ্টেম্বর রাতে ঘুমধুম এলাকা থেকে তিনজন ও ১৩ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ি সদর থেকে অপরজনকে আটক করা হয়।
বান্দরবান সেনাবাহিনীর ৬৯ পদাতিক বান্দরবান সেনা রিজিয়নের কর্মকর্তা (জিটুআই) মেজর মোহাম্মদ মেহেদী শনিবার সাংবাদিকদের জানান, আটক ওই চার মিয়ানমারের নাগরিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। গুপ্তচর বৃত্তির প্রমাণও মেলেনি। তাই গত বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) ৩১ বিজিবির মাধ্যমে তাদের তুমব্রু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। তবে তারা নজরদারিতে আছে।
এর আগে গত ৮ সেপ্টেম্বর ফটোগ্রাফি বিষয়ক বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘কাউন্টার ফটো’র প্রিন্সিপাল ফটোগ্রাফার সাইফুল হক অমিসহ মিয়ানমারের দুই ফটোসাংবদিককে হেফাজতে নেয় কক্সবাজার পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর বাংলাদেশি ফটোগ্রাফার অমিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও গ্রেফতার দেখানো হয় মিয়ানমারের দুই সাংবাদিককে। পরিচয় গোপন করে সীমান্তে গিয়ে ছবি তোলা, বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। কক্সবাজার জেলা কারাগারে আছেন তারা। মিনজাইয়ার ও এবং হকুন লাট নামের এই ব্যক্তি জার্মানির হামবুর্গভিত্তিক ম্যাগাজিন জিও-তে কাজ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সীমান্তে বসবাসরত অনেকেই জানিয়েছেন, কিছু কিছু রোহিঙ্গা টাকার বিনিময়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। দলে দলে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তারা এই কাজ করছে। এখন বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির প্রসার ঘটায় গুপ্তচরদের জন্য এই কাজ অনেকটা সহজ হয়েছে।
বিশেষ করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশে সব মোবাইল অপারেটর কোম্পানির অবাধ নেটওয়ার্ক চালু থাকায় প্রতি মুহূর্তের তথ্য সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব গুপ্তচরের দৈনন্দিন কাজ হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল, বিদেশিদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গতিবিধি, র‌্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকান্ড, তাদের অবস্থান, বাংলাদেশ সরকারের কর্মকান্ডের নানা প্রস্তুতির চিত্র, কথোপকথনের ভিডিও ও অডিও রেকর্ড করে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কাছে সরবরাহ করা। এর বিনিময়ে তারা আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছে।
মূলত ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশে বড় মাত্রায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ, রামু ও পার্শ্ববর্তী পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত অতিক্রম করে সেসময় প্রায় আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছিল। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে দুই দেশের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু অতি অল্প সময়ে সে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে যায়। এরপর থেকে মিয়ানামার থেকে নাফ নদী অতিক্রম করে এবং পাহাড়ি সীমান্ত পথ দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতেই থাকে। কক্সবাজারসহ দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ গত বছরের ৯ অক্টোবর থেকে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা এবং চলতি বছরের ২৫ আগস্ট থেকে এই পর্যন্ত চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এখনও তাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল বলেন, ‘কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ মিয়ানমার সীমান্তে যে পয়েন্ট গুলোতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বেশি সে সব জায়গায় পুলিশি নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। আমাদের পুলিশ সদস্যদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্তের গুপ্তচরবৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে জেলা পুলিশ কাজ করছে।’
টেকনাফ ২নং বিজিবি’র উপ-অধিনায়ক মেজর শরিফুল ইসলাম জমাদ্দার বলেন, ‘সীমান্তে গুপ্তচর নেই এটি অস্বীকার করার কিছু নেই, থাকতে পারে। নাইক্ষ্যংছড়িতে চার জন গুপ্তচর আটকের পর থেকে টেকনাফ সীমান্তে বিজিবি’র গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একইসঙ্গে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে কাজ করছে বিজিবি।’

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭ ৯:৪২ অপরাহ্ণ