উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি :
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ জুড়ে এখন শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। যেদিকে চোখ পড়ছে সেদিকে কেবল রোহিঙ্গার ঢল। সীমান্তবর্তী এ দুই উপজেলা রোহিঙ্গায় ছেয়ে গেছে। গ্রাম, রাস্তা, পাহাড় এবং নদীর পাড় রোহিঙ্গাদের দখলে গেছে। এ দুই উপজেলায় এখন জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশির চেয়ে রোহিঙ্গার হার বেড়ে গেছে। গতকাল শনিবার উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে হাজার হাজার বেসামাল রোহিঙ্গার ঢল। ঠাই নেই ক্যাম্পে। রাস্তার ২ পাশে বসে রয়েছে নারী শিশু। স্থানীয়রা গাড়ি নিয়ে গেলে রোহিঙ্গারা দৌড়ে আসে। ত্রাণ সামগ্রীর অপেক্ষায় রয়েছে ঐ সব রোহিঙ্গারা।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, গত ২ সপ্তাহে বাংলাদেশে ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে কক্সবাজার–টেকনাফ সড়কে যানজট এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বাজারে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম। কক্সবাজার মালিক গ্রুপের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ভয়াবহ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এখানকার জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। হাট–বাজার এবং সড়ক রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। শহীদ এটিএম জাফর সড়ক (কক্সবাজার–টেকনাফ সড়ক)ও মেরিন ড্রাইভ সড়কে রাত–দিন রোহিঙ্গাদের ঢল নামছে। রোহিঙ্গাদের ভিড়ের মাঝে যান চলাচলে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সড়কের দু পাশে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা অবস্থান করায় দূরপাল্লার যান চলাচলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক ফারুক আহমদ বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে বিকল্প আর কোনো সড়ক ব্যবস্থা না থাকায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। দূরবর্তী কলেজ এবং স্কুলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অনেকে যানবাহন সংকটে স্কুল–কলেজে যেতে পারছে না। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় এ সমস্যা দিন দিন আরো প্রকট হবে বলে মনে করছেন তিনি।
এদিকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বিক্ষিপ্তভাবে ঘোরাঘুরির সুযোগ না দিয়ে মানবিক কারণে তাদেরকে নির্দিষ্ট স্থানে রাখার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাইন উদ্দিন খান জানান,রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এখানকার আইন–শৃংখলা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয়, সে জন্য পুলিশের বিশেষ টিম দিন–রাত কাজ করছে। হোয়াইক্ষ্যং ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে না যেতে পারে সে জন্য তাদেরকে আপাতত বিজিবির তত্ত্বাবধানে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যং এলাকার অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হচ্ছে। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ জানান, এখনো স্রোতের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এদের অনেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং আশপাশের এলাকায় ঢুকে পড়লেও বেশির ভাগ রোহিঙ্গা ভাসমান অবস্থায় রাস্তাঘাটে, হাট–বাজারে অবস্থান করছে। যান চলাচল থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব পড়ছে। এদিকে কক্সবাজার–টেকনাফ সড়কে হাঁটার জায়গাটুকুও নেই। সর্বত্র রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। এরই মাঝে রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত শিশুরাও। এপারের আসা রোহিঙ্গাদের কেউ ছুটছে খাদ্যের সন্ধানে, কেউবা আশ্রয়ের সন্ধানে। এরই মাঝে চাপা পড়ে আছে আহতদের আর্তনাদ। রাখাইনের সহিংসতাপূর্ণ এলাকার হাজার হাজার বাসিন্দা গতকালও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। স্থলপথে, নৌ–পথে ও সাগরপথে বিস্তীর্ণ সীমান্ত দিয়ে এরা ঢুকে পড়ছে আর রাস্তার ধারে অথবা বন–বাদাড়ে বাঁশ–পলিথিন দিয়ে তৈরি করছে ঝুপড়ি ঘর। ইতোমধ্যে কক্সবাজার–টেকনাফ সড়কের কুতুপালং বাজার থেকে লেদা পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে রাস্তার ধারে ও পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে গড়ে ওঠেছে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের ঝুপড়ি ঘর। গতকাল শুক্রবার সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে,সীমান্ত পেরিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজার–টেকনাফ সড়কের কুতুপালং বাজার থেকে শুরু করে টেকনাফের লেদা পর্যন্ত রাস্তার দুধারে খালি জায়গায় ও পাহাড়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করছে। সেই সাথে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পায়ে হেঁটে আসছে নতুন নতুন রোহিঙ্গাও। আবার অনেকেই সাগরপথে সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে কক্সবাজার শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া,নাজিরারটেক, কলাতলী ঝরঝরিকুয়া ও বিসিক এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা।
এমনকি মহেশখালী, কুতুবদিয়া হয়ে পেকুয়া ও পটিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এছাড়া রামুর খুনিয়াপালং, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, টেকনাফের বাহারছড়া ও শামলাপুরেও বনাঞ্চলে ঘর তুলছে। তবে কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী শিবির ঘিরেই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল বিকালে কুতুপালং এলাকা পরিদর্শনকালে দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের বিরামহীন স্রোত। বয়স্করা মাথায় তল্পিতল্পা নিয়ে আর নারীরা শিশুদের কোলে নিয়ে পায়ে হেঁটে আসছে আশ্রয়ের সন্ধানে। ওদের মধ্যে অনেকে অসুস্থ। কেউবা আহত, গুলিবিদ্ধ। এদের কেউবা ঠাঁই নিচ্ছে রাস্তার ধারে অথবা অন্যের বাড়ির বারান্দায়। কেউ কেউ বাঁশ ও পলিথিন জোগাড় করে বনাঞ্চলে ও রাস্তার ধারে ধারে তৈরি করছে ঝুপড়ি ঘর। এভাবে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও সেখানে বিনা চিকিৎসায় কাতরাতে দেখা গেছে অনেক যুবক ও শিশুকে। মনজুর আলম (১৬) নামের এক গুলিবিদ্ধ শিশু রাচিদং অঞ্চলের ধুমছে এলাকা থেকে পরিবারের সাথে এসে আশ্রয় নিয়েছে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জের পরিত্যক্ত কার্যালয়ের বারান্দায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোঁড়া একটি গুলি শিশুটির ডান কানের পাশ দিয়ে ঢুকে মুখমণ্ডলের বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার কাঁধের বাম অংশেও গুলির চিহ্ন রয়েছে। শিশুটির পিতা আবদুস সালাম জানান, ধুমছে এলাকার রোহিঙ্গারা ভেবেছিল তাদের এলাকায় যেহেতু গণ্ডগোল হয়নি, তাই সেনাবাহিনী ও মগেরা তাদের ওপর আক্রমণ করবে না। কিন্তু ঈদের দুদিন আগে এক সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী ও মগেরা এসে গুলিবর্ষণ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এসময় অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। তিনিসহ বেঁচে যাওয়া অন্যরা পালিয়ে বনজঙ্গলে আশ্রয় নেন এবং পরে খাল–বিল ও জঙ্গল পেরিয়ে সাতদিন ধরে পায়ে হেঁটে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে পৌঁছেন। গুলিবিদ্ধ ৩ মাসের এক শিশুকে নিয়ে গতকাল বিকালে পালংখালী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেন আসমা নামের বিধবা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। এসময় তার দুগ্ধপোষ্য শিশুটিও গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরপর তারা এগারো দিন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে এসেছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আসমা তার গুলিবিদ্ধ সন্তানকে নিয়ে আসার সময় শিশুটির আর্তনাদ ছিল গগনবিধারী। পরে স্থানীয়রা শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসক বলেছেন, শিশুটির অবস্থা ভালো নয়। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক ডা. মারুফ জানান, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের কারণে চিকিৎসাপ্রার্থী মানুষের এখন খুব ভিড়। অসুস্থদের মধ্যে জখমপ্রাপ্ত ও গুলিবিদ্ধ রোগীও রয়েছে। এ চিকিৎসা কেন্দ্র ছাড়াও কুতুপালং এমএসএফ হল্যান্ড ক্লিনিকেও গুলিবিদ্ধ রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের প্রেরণ করা হয়। ইতোমধ্যে ২ শতাধিক গুলিবিদ্ধ রোগী এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনও নিচ্ছেন। যার মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। উখিয়া–টেকনাফের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে এবং সড়কের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে দূরে রাখার দাবি জানান। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গারা যাতে শহরে ও আশপাশে অবস্থান করতে না পারে, তার জন্য অনেকগুলো চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এরপরও কেউ অবস্থান নিয়ে থাকলে তাদেরকে আটক করে বালুখালী এলাকায় পাঠানো হবে।
দৈনিক দেশজনতা /এন আর