নিজস্ব প্রতিবেদক:
চায়না-বাংলা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (সিবিসি) বিরুদ্ধে ১৯ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটি মাত্র ৮ মাসে এই বিশাল ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। দাখিলপত্র বা ভ্যাট রিটার্নে পণ্য বিক্রির প্রকৃত তথ্য গোপন করার মাধ্যমে এই ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-মূল্য সংযোজন কর শাখা এ ফাঁকি উদঘাটন করেছে।
সিবিসি সিরামিকের ফাঁকিকৃত ভ্যাট পরিশোধে এলটিইউ থেকে দাবিনামা জারি করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি অন্য কৌশলে আরও ফাঁকি দিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে ২০০১ সালে মেসার্স চায়না-বাংলা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (সিবিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি সিরামিক ও টাইলস উত্পাদন করে। দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৬০০০ বর্গমিটার। নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে প্রতিষ্ঠানটির ফ্যাক্টরি।
সূত্র আরও জানায়, সিবিসি সিরামিক প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে এলটিইউ দুটি তদন্ত দল গঠন করে। তদন্ত দল প্রতিষ্ঠানটির নারায়নগঞ্জের কারখানা ও প্রধান কার্যালয় (ন্যাশনাল প্লাজা, ১০৯, বীর উত্তম সিআর দত্ত রোড, ঢাকা) পরিদর্শন করে। সেখান থেকে ভ্যাট রিটার্ন ও ২১টি ডেলিভারি রিপোর্ট সম্বলিত ইনভয়েস ফাইলসহ বিভিন্ন দলিলাদি সংগ্রহ করে। এছাড়া আর কোনো ইনভয়েস পায়নি তদন্ত দল।
দাখিলপত্র ও ইনভয়েস ফাইল পর্যালোচনা করে তদন্ত দল দেখতে পায়, প্রতিষ্ঠানটি যে পরিমাণ পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত ইনভয়েস বা ডেলিভারি চালান দেখিয়েছে তাতে ব্যাপক গরমিল রয়েছে।
যে পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করেছে তার তুলনায় দাখিলপত্রে কম দেখিয়েছে। এছাড়া মূসক-১১, মূসক-১৭ ও মূসক-১৮ রেজিস্টারে যথাযথভাবে বিক্রয় তথ্য এন্ট্রি না করে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
পরিদর্শনে জব্দ করা ২১টি ডেলিভারি রিপোর্ট সম্বলিত ইনভয়েস ফাইলের পণ্য সরবরাহের তথ্য পর্যালোচনায় করে প্রতিষ্ঠানটি ১৮ কোটি ৭৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫৯ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়।
২১টি ফাইল পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮ মাসের (২৫৮ দিন) মধ্যে ১৫৮ দিনে ৯৪ কোটি ৮২ লাখ ৬৫ হাজার ২৩১ টাকার পণ্য বিক্রয় করেছে।
এর বিপরীতে পরিশোধযোগ্য সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ১৪ কোটি ২২ লাখ ৩৯ হাজার ৭৮৫ টাকা হলেও প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৫ কোটি ৫৮ লাখ ২৭ হাজার ৮৫০ টাকা পরিশোধ করেছে।
মাত্র ১৫৮ দিনে বিক্রির বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে ৮ কোটি ৬৪ লাখ ১১ হাজার ৯৩৫ টাকা। এসময় পরিশোধযোগ্য মূসক (ভ্যাট) ১৬ কোটি ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার ৭৫৩ টাকা।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ১৫৮ দিনে মূসক পরিশোধ করেছে ৬ কোটি ৪১ লাখ ৬০ হাজার ৪৩৯ টাকা। অর্থাৎ ৯ কোটি ৯৪ লাখ ১৫ হাজার ৩১৪ টাকা ফাঁকি দিয়েছে।
জব্দ করা ২১টি ফাইল পর্যালোচনা করে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ মোট (৮,৬৪,১১,৯৩৫+৯,৯৪,১৫,৩১৪) = ১৮ কোটি ৫৮ লাখ ২৭ হাজার ২৪৯ টাকা ফাঁকি পাওয়া যায় বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সিবিসি সিরামিক মূসক আইন অমান্য করে মূসক চালান-১১ ব্যবহার না করে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ডেলিভারি চালানের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে পণ্য সরবরাহ করে আসছে।
এসব ডেলিভারি চালানে পণ্য সরবরাহের বিপরীতে বিল হিসেবে ইনভয়েস ইস্যু করে বিভিন্ন ব্যাংকে লেনদেন করে। এছাড়া ২১টি ইনভয়েস ফাইলে ৮ মাসে (২৫৮ দিন) এর মধ্যে মাত্র ১৫৮ দিনের তথ্য পাওয়া গেছে।
জব্দকৃত দলিলাদি ও দাখিলপত্র পর্যালোচনায় তদন্ত দল প্রতিষ্ঠানটির মূল্য ঘোষণা বহির্ভূত সি-গ্রেড এর বিভিন্ন সাইজের টাইলস উৎপাদন ও সরবরাহের (বিক্রয়) তথ্য পায়। যা মূসক আইন পরিপন্থী।
প্রতিষ্ঠানটি সি-গ্রেডের টাইলস উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো রাজস্ব পরিশোধ করে না। জব্দ করা ফাইলে ২০১৬ সালের ৭ মে থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত সি-গ্রেড টাইলসের তথ্য পায় তদন্ত দল।
এসময় প্রতিষ্ঠানটি ৭৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৭৫ টাকার সি-গ্রেড টাইলস বিক্রয় করে। এতে অপরিশোধিত সম্পূরক শুল্ক ৮ লাখ ৪১ হাজার ৫৪০ টাকা ও মূসক ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৭১ টাকা।
সি-গ্রেড টাইলস বিক্রয়ে (৮,৪১,৫৪০+৯,৬৭,৭৭১) বা ১৮ লাখ ৯ হাজার ৩১৯ টাকার সম্পূরক শুল্ক ও মূসক ফাঁকি দিয়েছে। তবে এর বাইরে আরও বেশি ফাঁকি দিয়েছে বলে ধারণা করছে তদন্ত দল।
৮ মাসের মধ্যে ১৫৮ দিনে বিক্রয় তথ্য গোপন করে ১৮ কোটি ৫৮ লাখ ২৭ হাজার ২৪৯ টাকা ও ঘোষণা বর্হিভূত সি-গ্রেড টাইলস বিক্রয় করে ১৮ লাখ ৯ হাজার ৩১৯ টাকার সম্পূরক শুল্ক ও মূসক ফাঁকি দিয়েছে।
দুইটি খাতে সিবিসি সিরামিক ১৮ কোটি ৭৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫৯ টাকার সম্পূরক শুল্ক ও মূসক ফাঁকির রহস্য উদঘাটন করেছে তদন্ত দল।
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে মেসার্স চায়না-বাংলা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে (০১৭১১৫৪৮৯৪৮) একাধিকবার কল দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।এছাড়া অফিসের টেলিফোন নম্বরে (০২-৯৬৬৮২৭৮-৯, ৯৬৭৬২১৩) ফোন দেওয়া হলেও তা রিসিভ করা হয়নি।
পরে চায়না সিরামিকের ম্যানেজার (একাউন্ট) কামাল হোসেনের নম্বরে (০১৭৩০৩০২১৩৩) একাধিক বার ফোন দেওয়ার পরও তাকে পাওয়া যায়নি।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ