২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১১:১১

বার্ধক্যজনিত রোগভোগে বুড়ো শয্যা নিয়েছে নান্দিবিনাশ

শিল্পসাহিত্য ডেস্ক:

বার্ধক্যজনিত রোগভোগে বুড়ো শয্যা নিয়েছে। অবস্থাগতিকে ঘুমঘোরেই কাটে তার দিবা-নিশি। কখনো-সখনো হুঁশ ফিরে আসার ভেতর দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা চালালেও মানুষটার কথা গুটিয়ে আসে। কানের কাছে মুখ নিয়ে উঁচু লয়ে ডাকলে তবেই সে এক-আধটু শুনতে পায়। চোখে ছানি সৃষ্টি হওয়ায় তার দৃষ্টিশক্তি নিভেছ অনেকখানি। সেই সঙ্গে চলছে শ্বাসকষ্ট। এহেন দুর্ভোগে দু’ছেলে আর দু’ছেলের বউ অবশ্য আন্তরিকভাবে বুড়োর সেবাযতœ চালায়। শুধু তা-ই নয়, বাড়ির কাজ সমান ভাগ করে নেওয়ার ধারায় তাদের মধ্য থেকে একজন না-একজন তার শিয়রে সারাক্ষণের হাজিরা রাখে। মাঝেমধ্যে রোগীর নিম্নগতি দাঁড়ায়। তাতে কবিরাজ এসে ওষুধ দিয়ে গেলেও কী পরিণতিতে কোনো নিরাময় ঘটছে! দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আইনুল গিয়ে বসে বাবার পাশে। বাড়ির লোকজন প্রতিদিনের নিয়মে খানিক বিশ্রাম নেয়। তারপর রোদ ধরে এলে দু’বউ সবজি জমিতে পানি দেওয়াও লেগে যায়। মাইনুল যায় গরুর ঘাস জোগানোর কাজে।
শেষ বিকেলের মিঠে রোদ লালচে রং নিয়েছে। তারও আগে জমিতে পানি দেওয়া হয়ে যেতেই সেই আলোয় বাড়ির দু’বউ হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় আসন নেয়, যেন বা একটু জিরোন পেতে। বুড়োর ছোট ছেলে মাইনুল ঘাস কাটার পালা তুলে বাড়ি ফিরে গরুগুলোকে গামলায় নুন ও চালের কুঁড়ো মেশানো পানি খাওয়ায়। তারপর সে গবাদিপশু ঢোকায় গোয়ালে। আর কখন কী সমস্যা হয় ভেবে বড় ছেলে আইনুল বাবার কাছটায় জায়গা নিয়ে আছে দুপুর থেকে। হঠাৎ সে খেয়াল করে, মানুষটা গায়ে মোচড় তুলে ঘুম ভাঙা চোখে তাকাল। আর ছেলেকে পাশে পেয়ে বুড়ো কী যেন কী বলতে চাইলেও তা গলায় আটকে যাওয়ায় গোঁ গোঁ আওয়াজই শুধু ধ্বনিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের সেই খবর জানাতে কাছে পেতে আইনুল হেঁকে ওঠে, কই গো তোমরা, তাড়াতাড়ি এসো! বাবার ঘুম যে ভাঙল!
তার ওই হাঁক শুনে মাইনুল এবং দু’ভাইবউ ত্রস্ত পায়ে ঢোকে ঘরে। কিন্তু বুড়োর দিকে তাকিয়ে তারা খেয়াল করল, ওমা, কোথায় কী! সে যে চোখ বুজে জবুথবু পড়ে আছে বিছানায়। তাই মাইনুল কিছুটা যেন বা বিরক্ত নিয়ে প্রশ্ন করে, ডাকলি যে, বাবা জাগনা কোথায়? নিশ্চয় বুঝতে ভুল হয়েছে তোমার।
ছোট ভাইয়ের জিজ্ঞাসা আইনুল অবশ্য বিব্রত বোধ করে। তার বিশ্বাস, বাবা যে ঘুম থেকে জেগে উঠে শব্দ করলেন, তা কোনো ভ্রম নয়। তাই সে আমতা আমতা স্বরে জবাব দেয়, এখনই তো তার গলা শুনলাম! তাহলে কি ফের ঘুমিয়ে গেল!
তারপর ব্যাপারটা পরখ করবার জন্য কিংবা নিজের কথার সত্যতা প্রমাণ করতে বড় ছেলে বুড়োর কানের কাছে মুখ নিয়ে জোর গলায় ডাকে, বাবা, ও বাবা! তুমি কি ঘুমে?
হুঁ।
আইনুল এতে বিজয় লাভের আনন্দে ছোট ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করে, দেখলি তো, এ আমার কোনো ভুল নয় রে, ভুল নয়। সেই প্রমাণ পেলি তো তোরা!
বড় ভাইয়ের কথা শুনে মাইনুল বলে ওঠে, হ্যাঁ, বাবার ঘুম তাহলে ভাঙল দেখছি।
আইনুল ডাকে, বাবা, ও বাবা, তাকাও তো, তাকাও। দেখো আমরা তোমার পাশেই আছি।
সেই ডাক পুরোপুরি বুড়োর কর্ণকুহরে পৌঁছে। তাই সে চোখ বুজে পড়ে থাকলেও জবাব করে, চাইলেও চোখ মেলতে পারছি কই আমি? কী যে ঘুম! মরণ ঘুম এরেই কয় রে বাপ!
অধিক বয়স হলে সময়ের ইঙ্গিতে মানুষের মৃত্যু সত্য আকার নেয়। বুড়োরও যাচ্ছে ওই দশা। অথচ সে যে এখন সুস্থ মানুষের মতো টানটান জবাব ফেরাচ্ছে! তাহলে কি প্রদীপের তেল নিঃশেষিত হওয়ার ঘটনায় শিখা যেমন দাপিয়ে উঠে নিভে যায়, বুড়োর মৃত্যুও তেমন ঘনায়মান? এতে উপস্থিত প্রত্যেকে উদ্বিগ্নচিত্ত হলেও আইনুল নিজেকে সামলে নিয়ে বাবাকে সমঝাতে বলে ওঠে, তুমি অত মরণ মরণ করো না তো! আসলে অসুখ থাকাতেই তুমি এমন কাহিল হয়েছ।
স্বামীর আলাপে তার স্ত্রীও সায় জানায়, ঠিক কথাই বলছে আপনার ছেলে। আপনার চাইতে কত বেশি বয়সের মানুষ দুনিয়াতে বেঁচেবর্তে আছে। তাহলে কী কারণে চিন্তা?
পরমুহূর্তে ছোট বউও বুড়ো শ্বশুরকে চাঙা করতে মুখ খোলে, বাবা, আমাদের কথা হলো অসুখ যত নয়, তার চেয়ে বেশি খালি পেট যাওয়াতেই আপনি কাহিল হচ্ছেন। এবারে কিছু মুখে দিন।
এই উক্তিতে বুড়ো বিড়বিড় স্বরে বলে উঠল, মাগো, ক্ষিদে থাকলে না কিছু মুখে ওঠে।
আরে, আরে, প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায় যায় মানুষটা দেখি টুপটাপ আলাপ জমাল। আবার বয়সের কারণে কানে খাটো হওয়ার পরও সব কথা সে স্পষ্ট শুনতেও পাচ্ছে। তা বুঝে আইনুলের বউ ডাকে, বাবা!
হুুঁ।
আপনার মুখে যে অনেক কথা ফুটলো। আচ্ছা, আজ বুঝি আগের চাইতে বেশ সুস্থ বোধ করছেন?
উত্তরে বুড়ো সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। তা খেয়াল করে বড় ছেলে বলে, অসুখে পড়লে খাওয়ায় অমন অরুচি সবারই হয়। তবে গায়ে জোর বাড়াতে হলে ওষুধের মতো করে হলেও কিছু গেলা চাই আপনার।
উঁহু।
কেন?
উত্তর ফেরে কই সেই জিজ্ঞাসায়! সত্যি, গত কদিনে মানুষটার খাওয়া-দাওয়া তলানিতে এসে ঠেকেছে। কখনো-সখনো হাঁপানির বাড় বাড়লে সে অস্থির হাত-পা ছোড়ে। তার ওপর রোগভোগ বয়ে চলার ফলে অধিকাংশ সময়ে বুড়োর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ লয়ে চলে। সকালবেলা অনেক কসরত চালিয়ে বুড়োর মুখে কয়েক চামচ দুধ ঠেসে দেওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে মানুষটা ঘুমেই বেহুঁশ পড়ে রয়েছে। মাঝে ডেকে ডেকেও কি জাগানো গেল তাকে যে, কেউ কিছু খাওয়াবে! এখন সময় বুঝে মাইনুল যুক্তি দেখায়, বাবা, শোনো, কে না জানে পেট খালি গেলে রোগের পোয়াবারো ঘটে। না, না, কিছুমিছু তো খেতেই হবে তোমাকে।
তারপর সে স্ত্রীর দিকে ফিরে ডাকে, কই গো, বাবার জন্য খাবার কি আছে খাবার, আনো।
বুড়ো বলে, সেসব পরে হবে। তার আগে তোদের সঙ্গে যে আমার জরুরি আলাপ আছে।
বড় ছেলে এতে চমকে প্রশ্ন করে, সে কী গো বাবা?
শোন রে ছেলে, শেষ বয়সের নিঃশ্বাসÑ কী বা বিশ্বাস! তারও আগে তোদের কাছ থেকে একখান জবাব পাওয়া খুবই দরকার। নইলে যে মরেও অশান্ত চিত্ত যাবে আমার!
এমন আলাপে দু’ছেলে আর দু’ছেলে বউ লক্ষ করে, কথা বলার পাশাপাশি বুড়ো চোখও মেলেছে। আর ঘরের পাটাতনের দিকে তার অপলক চাহনি নিবদ্ধ। তবে অন্ধের চোখ মেলা থাকলেও তার কাছে দিন-রাত বড়ই একাকার। এ অবস্থায় বাবার আকুলি-বিকুলিতে মাইনুল জানতে চায়, কী জবাব গো বাবা! আমাদের জ্ঞানে থাকলে বলব নিশ্চয়।
শোন, তোদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় আমি তিল তিল করে যা পারি ভূঁই জমিয়ে তুলেছি। তাতে দু’ভাই মিলেমিশে চাষ দিলে সারা জীবন মাছে-ভাতে ভরপুরই থাকবি। আজ যেভাবে তোরা চারজনে মিলেমিশে কাজ করছিস, এ রকম চালিয়ে যেতে পারলে তোদের মুঠোয় জমবে অর্থকড়ি।
বুড়োর অমন উক্তিতে বড় ছেলে বলে, বাবা, যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন একসাথ হয়েই চলব আমরা। কি, আমাদের কথায় তুমি নিশ্চয় শান্ত হতে পারলে। এবারে কিছু মুখে দাও তো!
এতে মানুষটা মাথা নেড়ে চলার পাশাপাশি জবাব ফেরায়, তোরা আছিস শুধু খাওয়া নিয়ে।
মাইনুল বলে, সে কী কথা গো বাবা? আচ্ছা, না খেয়ে খেয়ে কি নিজেকে মারতে চাও তুমি?
আমি বলি কী, সাবধান, দেখিস কারো ছলে পড়ে দু’ভাইয়ে জুদা হলেই কিন্তু তোরা নান্দিবিনাশের তলে পড়বি।
উপস্থিত চারজন বুড়োর গায়ে হাত রেখে জবাব দেয়, এত বড়টি হলাম, কই, দু’ভাইয়ে তো কখনো ঝগড়া-বিবাদ করিনি। বউরাও আছে ওই রকম এক হয়ে। তাহলে ভাবনা কী! নিশ্চয় বাকি দিনগুলোয়ও আমরা একাত্ম হয়ে থাকব। তুমি ওপারে বসে দেখবে, শত ছলেও আমরা চলছি হাতে হাত রেখে। কী, এবারে থির হতে পারলে তো?
ছেলের মুখ থেকে অমন জবাব পেয়ে মানুষটা বলে, আহ্, তাহলে দেখছি মরেও আমার শান্তিতে থাকার উপায় হলো।
কথা শেষে বুড়ো চোখ বোজে। এতে প্রত্যেকের মনে কিন্তু সন্দেহ উঁকি দেয়, আচ্ছা, সে কী চিরনিদ্রার দিকে যাচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জাগিয়ে তুলবার প্রয়াসে আইনুল ডাকে, বাবা, ও বাবা।
উত্তর আসে, কী যে ঘুম!
এতে কেউ কোনো জবাব খুঁজে পায় কই! উলটা দুশ্চিন্তা নিয়েই তারা বুড়োর কাছাকাছি বসে থাকে। অবশ্য সারাক্ষণই তাদের দৃষ্টি পড়ে রয় মানুষটার দিকে। আর দেখে দেখে মনে হয়, অন্তহীন ঘুমেই যেন সে তলিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে তাকে যেন ফেরানোর নয়।
তারও কিছু বাদে পৃথিবীর নিয়মে সূর্য অস্তাচলে যায়। এতে ছায়া ছায়া আঁধার একের পর এক এসে জমা হয় অন্দর-বাহিরে। তাই সময়ের ডাকে বড়বউ সন্ধ্যা বাতি দেয় ঘরে। সেই আলোয় আইনুল খেয়াল করতে পারে, বুড়োর বুকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কোনো ওঠা-নামা নেই। ফলে সন্দেহ নিয়েই সে বাবার বুকে হাত রেখে চিৎকার করে ওঠে, দেখ তো, তোরাও দেখ, বাবা কি বেঁচে নেই? ভাই রে, তার তো নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গেছে।
পরমুহূর্তে সবাই মিলে বুড়োর গায়ে হাত রাখতেই অনুভব করে, হ্যাঁ, মৃতের শীতল-কঠিন দেহই তো এখনো। তাই কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, মানুষটা চিরনিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আপনজনকে হারাবার শোকে তারা সমস্বরে বিলাপ করে। তারই দুঃখজাগানিয়া স্রোতে লাশের বুকে মাথা রেখে তারা কান্নাভাসা হয়ে চলে। সান্ধ্য হাওয়ার তোড়ে ওই শোকের মাতম দূর থেকে আরও দূরের পথেই এগোয়। তা শুনতে পেয়ে ছুটে আসে তাবৎ প্রতিবেশীও।

দুই.
আপনজন কেউ মারা গেলে গভীর শোক বড়ই মন্থন দেয়। তাতে মানুষ মনের পীড়নে কি কাবু না হয়ে পারে! আবার এও ঠিক যে, সময়ের বহমানতায় সেসবের দুঃখভার কমেও আসে। আগের মতো অত ভারী থাকে না শোক-তাপ। হিসাব কষলে দেখা যায়, বুড়ো মারা গেছে তিন মাস আগে। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক দিনই বাড়ির কেউ না কেউ তার প্রসঙ্গ টেনে আনে। এতে সবার মধ্যেই মানুষটাকে ঘিরে নিজ নিজ অধ্যায়ের নানা টুকরো-টাকরা স্মৃতি দোদুল দোল খেলে। সেদিন দু’ছেলে এবং দু’ছেলের বউ বসেছিল বারান্দায়। দিনমান বৃষ্টি গেছে। ফলে তাদের বাইরের কাজকর্ম গুটিয়ে রাখতে হয়েছে। শেষে মেঘ কেটে গিয়ে বিকেলের সূর্য উঁকি দেয় আকাশে। এখন সেই আলোয় সরষে তেল, পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা কচলে তাতে মুড়ি মিশিয়ে তারা খাচ্ছিল বেশ আস্বাদন নিয়ে। হঠাৎ আইনুলের চোখ যায় ছোট ভাইয়ের দিকে। সে যে বাবার মতো একই ভঙ্গিমায় মুড়ি চিবোচ্ছে। তাই বড় ভাই চমকে বলে ওঠে, মাইনু রে, তুই দেখছি বাবার মতো করেই মুড়ি চিবিয়ে চিবিয়ে তবেই গিলিস।
আইনুলের এই হঠাৎ নিরিখে মাইনুল বেশ অবাক মানে। তবে সত্য হচ্ছে, নিজেকে কি নিজে ঠিক বুঝতে পারা যায়? তাই সে জবাব দেয়, কী জানি কী!
উপস্থিত বড় বউ স্বামীর অমন আলাপে দেবরের দিকে তাকিয়ে নিজেও ব্যাপারটা মিলিয়ে নেয়। হ্যাঁ, অতীতে ব্যাপারটা খেয়াল না করলেও এখন মনে হচ্ছে কথাটা ঠিক। ফলে ও জবাব দেয়, আসলেই তো, বাবা মাইনুর মতো করেই মুড়ি খেতেন।
এসব কথনে ছোটবউয়ের ভাগ নেওয়ার অধিকার আছে। এ বাড়িতে আসার পর শ্বশুরের স্বভাব ওর পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা হয়েছে। তাই নিজের মত ফলাতে মাইনুলের বউ সায় জানায়, আগে টের না পেলেও এখন বুঝলাম ঠিক, খুবই ঠিক ব্যাপারখানা।
যাকে নিয়ে এত কথা, সে কিন্তু উপস্থিত প্রত্যেকের মন্তব্য শোনে আগ্রহ নিয়েই। তারপর সে জবাব দেয়, বাবা কেমন করে মুড়ি খেতেন তা কী আমি কখনো খেয়াল করেছি নাকি। তোমরাই শুধু বুঝতে পারো বাবার মতো মুড়ি খাই কি না আমি। তবে তোমরা যা-ই বলো না কেন, সারাক্ষণ নিজে কী ভাবি জানো?
আইনুল এতে কৌতূহলী স্বরে জানতে চায়, কী রে!
বাবা যেমন চেয়েছিলেন তেমন এক হয়েই তো বেঁচে আছি আমরা।
আইনুল এতে মাথা দুলিয়ে বলে ওঠে, খুবই সত্য রে। পরপারে শুয়ে থাকলেও আমাদের চলাফেরা দেখে বাবা নিশ্চয়ই খুব খুশি!
দুই ছেলে আর তাদের দু’বউও বুড়োর থুয়ে যাওয়া সম্পত্তির বদৌলতে ভালোই খেয়ে-পরে আছে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া উত্তর এবং দক্ষিণ ভিটায় দু’খানা টিনের ছাওনি দেওয়া ঘরে দু’ভাই নিজ নিজ বউ নিয়ে থাকে। জমি-জিরেত যা আছে তাতে ধান ফলিয়ে বছর চলে গিয়েও বিক্রি বাবদ আলমারিতে জমা হয় টাকা। প্রতিবেশীরা কোথাও ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বাধলে আইনুল এবং মাইনুলের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলে, ভাই ভাই কেমন ঠাঁই ঠাঁই তাদের দিয়েই শেখো গো তোমরা।
সত্যিই, একাকী শিশু যেমন অন্য এক শিশুকে কাছে পেয়ে গলায় গলায় ভাব করে, বুড়োর দুটো ছেলেও তেমন একে অপরে মিলেমিশে আছে। তাদের দু’বউও আছে তেমন গলাগলি ভাব নিয়ে। বাড়ির কাজকর্ম নিয়ে কেউ কাউকে তাগাদা দেবে কী, বরঞ্চ দেখা যায় একজন মাছ কাটতে বসে তো অন্যজন ছুটে যায় কুয়োতলায় বাসনপত্র নিয়ে। আবার চাষবাসের প্রয়োজনে দু’ভাই দিনমান পড়ে থাকে খেতে-খামারে। সেই কাজেরও নানা পর্ব আছে। জমিতে লাঙল দাও, মই দিয়ে মাটি নরম করো, বীজ বোনো, পানি দাও ইত্যাদি নিয়ম করে তবেই ফলন তুলতে হয় ঘরে। আজ জমিতে চাষ দেওয়া শেষে দু’ভাই নেমে যায় পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বোরো জমিতে। ওখান থেকে বছরে একবার ধান যেমন আসে, চৈত্র মাসের খরায় পানি কমে আসার ভেতর দিয়ে তলানিতে পাওয়া যায় নানা পদের মাছ। তারা বোরো জমির পানি সেচে পায় বেশ কিছু শিং, কৈ, খোলসে, টেংরা, পুঁটি, বুইচা, চান্দা ইত্যাদি ছাড়াও মাঝারি আকারের একটা শোল মাছ। শোল মাছ লাউয়ের সঙ্গে মজে ভালো। তাই আইনুল ঘর ফিরতি পথে নিজেদের মাচান থেকে একখানা লাউ কেটে নেয় কচি দেখে। আর বাড়িতে ফিরে সে বউকে বলে, শোল মাছের ভুনা রাঁধো। সাথে বেশি বেশি পেঁয়াজ, রসুন দিও। আর মাথা, লেজ দিয়ে হবে লাউয়ের তরকারি। অন্য মাছ বেগুন দিয়ে মজালেই তো খেতে স্বাদ হয়।
স্বামীর আবদারে স্ত্রী জবাব দেয়, তা না হয় রাঁধলাম আমি। ওদিকে গুঁড়া মাছ এনেছ অনেকগুলো। সব কি এক দিনে খেয়ে ফুরানো যাবে?
সেই জিজ্ঞাসায় মাইনুলের বউ বলে, ভাবি, ছোট মাছগুলো রোদে দিয়ে শুঁটকি করে নিলে পরেও তো খাওয়া যাবে।
তা শুনে বড়বউ উত্তর করে, খুব যে বুদ্ধি তোর। ওই জন্যই সবার কত আদর পাচ্ছিস। এখন যা তো, জলদি হাতে ওগুলো ধুয়ে নিয়ে তুই রোদে দে। রান্নাটা সামলাই আমি।
দু’ভাই যায় কুয়োতলা। তারা গোসল সেরে এসে বসে গরুর দড়ি পাকানোর কাজে। ওই ফাঁকে রান্নাবান্না শেষ করে বড়বউ। আসে খেতে যাওয়ার ডাক। একত্রে বসার পর বড়বউ তিনখানা ভাজা কৈ মাছ তুলে দেয় তিনজনের পাতে। নিজেও নেয় একখানা। এ বাড়িতে আসা অবধি দেওয়া-থোওয়ার দায়-দায়িত্ব ওর দিকেই বর্তায়। এ নিয়ে কখনো কারও অনুযোগ তুলবার সুযোগ ঘটেনি। সেদিন দেওয়া-থোওয়ার একপর্যায়ে এসে আইনুলের বউ লাউয়ের ভেতর মজানো শোলের আস্ত মুড়োটা স্বামীর পাতে তুলে দেয়। তবে মনে মনে ভাবে, পরে বড় শোল পেলে না-হয় মুড়োটা দেওয়া যাবে ছোটকে। বেশিরভাগ দিনেই তো দেবরের পাতে দেওয়া হয় ভালোটা। এতে নিশ্চয় মাইনুল এবং তার বউ কোনো দোষ নেবে না।
তবে ও কোত্থেকে জানবে যে, এতে ভাগ্যে দোষ লেখা হয়ে গেছে। কেননা, ছোট বউ কিন্তু আড়ে আড়ে দেখে চলে ব্যাপারটা। আসলে শোল মাছটা বাড়ি আনা অবধি মুড়ো খাওয়ার লোভ হচ্ছিল নিজেরই। কিন্তু বলি বলি করেও লজ্জার কারণে মুখ ফুটে ভাবিকে তা জানানো হয়নি। তা না হয় হলো, নিজের পাতে পাওয়া না-হোক, দেবরকেই তো মুড়োটা দেবে ভাবি। কিন্তু কোথায় কী! এখন সেটা ভাশুরের পাতে যাওয়ায় ওর লকমা তোলা থেমে যায়। বড়দের পাশে থেকে ও শিখেছে, সংসারে ভালো কিছু রান্না হলে সেটা বাড়ির ছোটকেই খাওয়াতে হয়। তা নয়, উনি কিনা তুলে দিলেন স্বামীর পাতে। তবে মনে এই ভাব জন্ম নিলেও বাইরে অবশ্য তা প্রকাশ পেতে দিল না মাইনুলের বউ। আর এ রকম ভাবনায় মুখ কালো হয়ে ওঠার পাশাপাশি ওর পেটপুরে খাওয়াও বাদ রইল। তা সত্ত্বেও অন্যদিনের নিয়মে খাওয়া শেষে চুপচাপ এঁটো বাসনপত্র নিয়ে ও ছুটে যায় কুয়োতলা। আজ ধোয়ার কাজে ওর হাত চলে কম। খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই উঠে যাওয়ার পর বড় বউ ভাত-তরকারির পাতিল একদিকে সিজিল করে। পরে ও লেগে যায় রান্নঘর ঝাঁট দেওয়ার কাজে। আর হাতের কাজ গুছিয়ে দু’বউ গেল ঘরেÑযার যার স্বামীর কাছে।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর দু’ভাই সাধারণত বিছানায় খানিক গড়াগড়ি যায়। ওই সময় দু’বউও নিজ নিজ স্বামীকে সঙ্গ দেয়। আজ প্রতিদিনের নিয়মে ঘরে ঢুকে বড়বউ এক খিলি পান বানিয়ে তুলে দেয় স্বামীর হাতে। তারপর বলে, কতদিন হয় আমার বাবা-মা, ভাইবোনকে দেখতে যাওয়া হয়নি। আসছে কাল আমি কিন্তু বাপের বাড়ি যাব।
আইনুল জবাব দেয়, কাজের চাপে মাথা তুলে কোথাও কি বেড়াতে যাওয়ার উপায় আছে! তবে নিজেরও ইচ্ছে, যাই কোথাও। কিন্তু শুধু আমরা দুজন কেন, তোমার বাপের বাড়িতে যাওয়ার সময় মাইনুল ও তার বউ থাকবে সঙ্গে।
সেসব আবার কবে বাদ থাকছে! যাবে, তারাও যাবে।
আইনুল পান চিবোতে চিবোতে বলে, কথায় আছে, ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই। আমরা দু’ভাইও কিন্তু এক হয়ে আছি।
স্বামীর এমন আলাপে স্ত্রী কপট রাগ দেখিয়ে প্রশ্ন তোলে, নিজেদের নিয়ে খুব যে বড়াই দেখাচ্ছ! আর আমরা যে দু’বউ তোমাদের সঙ্গে মিলেমিশে আছি, সেসবের বুঝি নাম নেই?
আইনুল হেসে জবাব দেয়, তা কী আর বলতে! আরে, তুই কী আমার আলাদা কেউ? আবার গিয়ে দেখ আমার মতো মাইনুল নিশ্চয় বউয়ের মাঝে তোর-আমার মতো এক হয়ে মিশে আছে।
ইস, খুব যে প্রেম প্রেম ভাব দেখাচ্ছ!

 

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ২, ২০১৭ ৩:২২ অপরাহ্ণ