খুলনা প্রতিনিধি:
খুলনার দিঘলিয়া গণহত্যা দিবস ২৭ আগস্ট। ১৯৭১ সালের এ দিনে উপজেলার দেয়াড়া গ্রামে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নিরীহ ৬০ জন গ্রামবাসী প্রাণ হারান। দিঘলিয়া উপজেলাবাসী গণহত্যা দিবস হিসেবে এ দিনটিকে পালন করে আসছে। এদিকে কেউ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হলেও শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজ রাখেনি। এখন তাদের দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। এমনকি শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্যও সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। খুলনা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরত্বে ভৈরব নদীর পাশ ঘেঁষে দিঘলিয়া উপজেলা। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ উপজেলার মধ্যে দেয়াড়া গ্রামের নিরীহ মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে বিহারিদের কলোনি থাকায় নিরীহ বাঙালিদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট ভোরে সাবেক ছাত্রনেতা শেখ আবদার রহমান তার দলবল নিয়ে উপজেলার দেয়াড়া নিজ গ্রামে অবস্থান করছিলেন। এ খবর পেয়ে কয়েক’শ রাজাকার, বিহারি ও পাক-হানাদার বাহিনী তার বাড়িসহ গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে। ওই বাড়ি থেকে একই পরিবারের ৬ সদস্য ডা. মতিয়ার রহমান, তার চাচাতো ভাই পিরু ও আলী, ভাগ্নে ইসমাঈল হোসেন ছোট খোকা, জামাই আব্দুল জলিল, সহোদর আব্দুল বারিক, হোসেন সরদার, মো. আজিম হোসেন, সাত্তার শেখ ও পরা মনিককে ধরে নিয়ে যায়। একই রাতে গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে আরো ৫৫ জনকে ধরে নিয়ে যায়। সকাল ৯টার দিকে দেয়াড়া বিহারি কলোনির পৃথক তিনটি স্থানে তাদের গুলি ও গলাকেটে হত্যা করা হয়। রাজাকাররা ২২ জনের লাশ পৃথক তিনটি স্থানে গণকবর দেয়। বাকি লাশগুলো পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এ সময় লাশের মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা সৈয়দ আবুল বাসার ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তার পরিবারের সদস্যরা লাশের স্তূপ থেকে তাকে তুলে নিয়ে আসে। কঠোর সতর্কতার মধ্যে তাকে চিকিৎসার জন্য খুলনা জেনারেল (সদর) হাসপাতালে নেওয়া হয়।
নিহত মুক্তিযোদ্ধা ডা. মতিয়ার রহমানের ছেলে আফজাল হোসেন বলেন, ‘বাবাসহ একই পরিবারের ৬ জন এবং আরো ৫৫ জনকে স্থানীয় বিহারি কলোনিতে নিয়ে যায়। সেখানে ৬০ জনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ না নেওয়া দিঘলিয়াবাসীর জন্য খুবই কষ্টদায়ক।’ গণহত্যায় নিহত শহীদ আজিমের ছেলে আ. জব্বার বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকহানাদার ও রাজাকাররা দেয়াড়া এলাকা থেকে ৬০ জনকে ধরে বিহারি কলোনিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মারতে থাকে। এ সময় আমার বাবা আজিম ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতিবাদ করেন। তখন রাজাকাররা তাকেও গুলি করে মেরে ফেলে। আমাদের দেখার কেউ নেই। ঠিকমত পরিবারের সদস্যদের আহার জোগাড় হয় না। অর্ধাহার-অনাহারে থেকে যক্ষ্মায় আক্রান্ত আমার মা বিনা চিকিৎসায় ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর মারা গেছেন।’
শহীদদের এ গণকবর সংরক্ষণ ও তাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলেও ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি স্থানীয়ভাবে শিল্পপতি মুক্তিযোদ্ধা কাজী শাহ নেওয়াজ স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন । তার নিজস্ব জমিতে থাকা একটি গণকবরের পাশে ২য় গণকবরটি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহীদদের পরিবারের পক্ষ থেকে এ দিনটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়।