২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৭:২৪

যানজটে ঈদমুখী যাত্রীদের নাভিশ্বাস চরমে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশের বিভিন্ন রুটে তীব্র যানজটে ঈদমুখী যাত্রীদের নাভিশ্বাস চরমে পৌছেছে। দীর্ঘ ২৩ কিলোমিটার জুড়ে তীব্র যানজটে আটকা পড়েছে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন ধরণের যানবাহন।
মির্জাপুর ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য জানান, শনিবার সকাল ৯টা থেকে মহাসড়কের চন্দ্রা এলাকায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় এ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে । তিনি বলেন, ২৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃতি ঘটেছে যানজটের। এর আগে শুক্রবার রাত ১১টার দিকে মহাসড়কের কালিয়াকৈর ওভারব্রিজ এলাকায় রড ভর্তি একটি ট্রাক বিকল হলে যানজটের সৃষ্টি হয়।
ভয়াবহ খারাপ অবস্থায় রয়েছে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক। ঢাকা উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের ভোগান্তির শুরু টাঙ্গাঈল থেকে।
শুক্রবার বিকেলের পর থেকে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া উত্তরাঞ্চল থেকে গরু ভর্তি শত শত ট্রাক চলাচল শুরু করলে যানজট প্রকট আকার ধারণ করে। নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়া রাজধানীর মানুষ এ কারণে অনেকখানি অস্বস্তিতে পড়েছে। ঈদ যাত্রা শুরু হওয়ার আগেই মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে প্রতিদিনই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকছে। ঈদ যতই এগিয়ে আসছে যানজটও ততই বাড়ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া পর্যন্ত প্রতিদিনই প্রায় সার্বক্ষণিক যানজট লেগে থাকছে। গতকাল দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতি নদীর টোল প্লাজা থেকে আমিরাবাদ পর্যন্ত অন্তত ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যানজট তৈরি হয়। এতে কোরবানির জন্য রাজধানীর আশেপাশে আসা পশুবোঝাই ট্রাক, চট্টগ্রাম নৌ-বন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাতায়াতকারী যানবাহনগুলো যানজটের কবলে পড়ে। একই সঙ্গে ভোগান্তি পোহাতে হয় রাজধানী ঢাকা থেকে সিলেট বিভাগসহ কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী এলাকায় যাতায়াতকারী কাভার্ডভ্যান, মালবোঝাই ট্রাক, লরি, যাত্রীবাহী বাস ও প্রাইভেটকারসহ ঈদগামী ঘরমুখো মানুষদের।
অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় অনেককে ঈদ যাত্রা শুরু হওয়ার আগেই গ্রামে চলে যেতে দেখা গেছে। সেই জন্য গাবতলীতেও অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ থাকায় কিছুটা যানজটও তৈরি হয়। তবে মহাসড়কে যানজট থাকলেও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও মাওয়ার শিমুলিয়া-কাঠালিয়া ফেরিঘাটে স্বাভাবিক ছিল ফেরি চলাচল। হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, কয়েকটি স্থানে গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়ায় যানজট তৈরি হয়েছে। সেসব স্থানে তারা হস্তক্ষেপের পর স্বাভাবিক হয়েছে যানচলাচল। সওজের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রধান ৬টি মহাসড়কের দশা-ই মারাত্মক বেহাল।
জেলার মির্জাপুর উপজেলা থেকে অ্যালেঙ্গা পর্যন্ত ৪৫ কি.মি. সড়কে খানাখন্দ থাকায় এখনই প্রায় ২৫ কি.মি. দীর্ঘ যানজট লেগে থাকছে মহাসড়কের এই অংশে। সব মিলিয়ে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরসহ ওই মহাসড়কে ১৪৭ কি.মি. রাস্তার দশা বেহাল। চালকরা বলছেন, রাস্তা প্রচণ্ড ভাঙাচোরা। ঠিকমতো চালানো যাচ্ছেনা। গাড়ি চালাতে চালাতে গা গতর ব্যথা হয়ে যায়। চালাতে গেলে গাড়ি কাত হয়ে যায়। বাত্তি ভেঙে যায়। ভাঙাচোরা রাস্তা ৬/৭ দিন ধরে ইটের খোয়া দিয়ে মেরামত করে।
আবার একটা বৃষ্টি আসলে সব ধুয়ে ভেঙে যায়। ঢাকা খুলনা মহাসড়কের ১৩০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার রাস্তা প্রায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যশোর-বেনাপোল, মাগুরা-ঝিনাইদহ এবং নড়াইল সড়কের বেশ কিছু অংশে যান চলাচল করছে ঝুঁকি নিয়ে।
ঢাকা-সিলেট সড়কের দুর্ভোগ শুরু ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। এই মহাসড়কে বিচ্ছিন্নভাবে ১২০ কিলোমিটার রাস্তা ভাঙাচোরা। সিলেটের অন্তত ৭০টি অংশে রয়েছে খানাখন্দ ও বড় বড় গর্ত। এই মহাসড়কের ভাঙাচোরা অংশে ৫ ঘণ্টার রাস্তা পার হতে সময় লাগছে ৭/৮ ঘণ্টা।
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বরিশাল অংশের ৪৬ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে অন্তত ৩০ কিলোমিটার রাস্তা প্রায় চলাচলের অনুপযোগী। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ঘুরঘাটা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১৬২ কিলোমিটার সড়কের বেশিরভাগেই রয়েছে বড় বড় গর্ত।
গুরুত্বপূর্ণ এই চার মহাসড়ক ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অন্তত ২ কিলোমিটার রাস্তাও মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে বানিয়াচর পর্যন্ত রাস্তায় চলাচল করা দুষ্কর। অন্যদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা মহাসড়কে কমপক্ষে ৬২ কিলোমিটার রাস্তা খানাখন্দে পূর্ণ। এই মহাসড়কের শুরু টঙ্গি থেকে চান্দুরা পর্যন্ত দুর্ভোগের শেষ নেই।
গত বৃহস্পতিবারও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট ছিল। ওই দিন দুপুরে সেতুমন্ত্রী মেঘনা ও গোমতী সেতুর টোল প্লাজা পরিদর্শনে গিয়ে ঈদযাত্রায় আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ঈদে যান চলাচল সচল রাখার সব চেষ্টার কথাও জানান। কিন্তু গতকাল অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি।
গতকাল মন্ত্রীর সফরের সময় পুলিশ এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ঈদে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি এবং যানবাহন বিকল হওয়ার কারণে যানজট হচ্ছে। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্রগুলো বলছে, আগামী সোমবার থেকে ঈদের মূল যাত্রা শুরু হবে। তাই এখনো ঈদের চাপ পুরোপুরি শুরু হয়নি। ঢাকামুখী কোরবানির পশুবাহী যানবাহনও তেমনভাবে আসা শুরু হয়নি। এখনকার যানজটের মূল কারণ সড়কের খানাখন্দ। কিছু কিছু স্থানে খানাখন্দ মেরামতের কারণেও যানবাহনের গতি কমে জট হচ্ছে। সেতুর টোল আদায়ে ধীরগতি ও ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে হয়রানিও বড় কারণ। ব্যবস্থাপনাতেও ত্রুটি আছে।
সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার মেঘনা সেতু থেকে ঢাকার দিকে যে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়, তা শুক্রবার রাতেও অব্যাহত ছিল। দুপুরের দিকে মেঘনা সেতুর টোল প্লাজার ওজন পরিমাপ কেন্দ্রে দেখা যায়, শত শত ট্রাক-লরি দাঁড়িয়ে আছে।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, পাটুরিয়া ঘাটে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া যানবাহন দেড় থেকে তিন কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আটকে থাকতে দেখা গেছে। এই পথে ১৯টি ফেরির মধ্যে ১৪টি চালু আছে। বি আইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. সালাউদ্দিন বলেন, স্রোতের কারণে ফেরির যাতায়াত কমে গেছে। যানবাহনের চাপ বেশি থাকায় কিছুটা জট হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, গতকাল দুপুরে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে প্রায় ৫০০ যানবাহনের সারি দেখা গেছে। এর মধ্যে ট্রাক ও ছোট গাড়িই বেশি ছিল। ঘাটের সহকারী পরিচালক শাহ মো. খালিদ নেওয়াজ বলেন, স্রোতের কারণে ফেরি পারাপারে সময় বেশি লাগছে। এ জন্য কিছুটা জট হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জে শুধু মহাসড়ক নয়, আঞ্চলিক সড়কেরও বেহাল অবস্থা। প্রতিটি সড়ক খানাখন্দে ভরে গিয়ে মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে জোড়া-তালি দিয়ে চলছে এসব সড়ক-মহাসড়কের সংস্কার কাজ।
সিরাজগঞ্জ (সওজ) অতিরিক্ত দয়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী মোফাজ্জল হায়দার জানান, কোরবানি ঈদ সামনে রেখে আমরা দ্রুতগতিতে সংস্কার কাজ করে যাচ্ছি। আবহাওয়া ঠিক থাকলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই  মেরামতের কাজ শেষ হবে।
ভোলা প্রতিনিধি জানান, বরিশাল, খুলনা, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চলের যে কোনো জেলা থেকে ভোলার ইলিশা ফেরিঘাট হয়ে প্রমত্তা মেঘনা পাড়ি দিয়ে লক্ষ্মীপুর হয়ে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ ২৬ জেলায় সহজে যাতায়াতের ভোলা সদর উপজেলার পরানগঞ্জ থেকে ইলিশা ফেরিঘাট পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার সড়কের এখন  বেহাল দশা।
কলমাকান্দা (নেত্রকোনা) সংবাদদাতা জানান, নেত্রকোনা- কলমাকান্দা সড়কটি জেলার সাথে যোগাযোগের একমাত্র সড়ক। সরেজমিনে দেখা যায় কলমাকান্দা-নেত্রকোনা সড়কটিতে বাহাদুরকান্দা, বামনী, তেগুরিয়া, হিরাকান্দা, আশারানী, পাবই, উড়াদিঘি নামক স্থানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় এলাকাবাসী চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে।
রংপুর প্রতিনিধি জানান, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবর্ষণ সৃষ্টি হওয়া বন্যায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের রংপুর জোনের ১০ জেলায় ৬২৯ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৭০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক তাৎক্ষণিক মেরামত করতে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে সড়ক ও জনপথ অফিস সূত্রে জানা যায়।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :আগস্ট ২৬, ২০১৭ ৩:৪৮ অপরাহ্ণ