২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:১৫

মুশফিক, অবহেলার জবাব দেওয়া চাই

দৈনিক দেশজনতা ডেস্ক:

রাত পোহালে কাল সকালেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নামছে বাংলাদেশ। মিরপুর শেরে-ই বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের এই টেস্টের আগে মুশফিক, সাকিব, তামিমদের চোখ নিশ্চয় অন্য রকম খুশিতে চকচক করছে? মনের কোণে খেলা করছে রোমাঞ্চের শিহরণ? অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ক্যারিয়ারে প্রথম বারের মতো টেস্ট খেলতে নামছেন, মুশফিক-সাকিবরা রোমাঞ্চ অনুভব করারই কথা। তবে সেই রোমাঞ্চের উল্টো পাশে একটা চাপা কষ্টও নিশ্চয় বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুষড়ে দিচ্ছে? অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কষ্ট!

‘বড় ভাই’দের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা ‘ছোট ভাই’দের জন্য পরম পাথেয়। পায় স্বর্গীয় সুখ। তেমনি বড় ভাইদের অবহেলা, তাচ্ছিল্য ছোট ভাইদের কষ্টের আগুনে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেয়! টেস্ট পরিবারের ‘বড় ভাই’ অস্ট্রেলিয়া ‘ছোট ভাই’ বাংলাদেশকে সেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই করে গেছে শুধু! বাংলাদেশকে যথাযথ প্রতিপক্ষ হিসেবে মর্যাদা-সম্মান দেয়নি অজিরা। সমমর্যাদায় বুকে টেনে নেওয়ার বদলে আত্ম-অহমিকার মিথ্যা বড়াই করে ‘ছোট’ বলে বাংলাদেশকে এড়িয়ে চলেছে!

প্রতিপক্ষ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ানরা বাংলাদেশকে কতটা অবহেলা, তাচ্ছিল্যর চোখে দেখে, পরিসংখ্যানই বলছে সেটা। ‘ছোট’ প্রতিবেশী বাংলাদেশকে টেস্ট আতিথেয়তা দিতে ১৭ বছর লাগিয়ে দিয়েছে নিজেদের ‘মহাপরাক্রমশালী’ ভাবা ভারত। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ‘ছোট’ বাংলাদেশকে যথাযথ প্রতিপক্ষের মর্যাদা না দেওয়ার প্রতিযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ানরাই চ্যাম্পিয়ন! দাম্ভিকতার পোষাকে ভারত বাংলাদেশকে তাদের দেশে দাওয়াত দিতে কার্পণ্য করলেও বাংলাদেশ সফরে এসেছে ৪ বার। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ তাই ভারতের সেঙ্গে খেলেছে ৯টি টেস্ট। সেখানে অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে টেস্ট খেলেছে মাত্র ৪টি। যার সর্বশেষটি সেই ২০০৬ সালে। একমাত্র মুশফিকুর রহীম ছাড়া, তার এই টেস্ট দলের বাকি কারো তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকই হয়নি!

মুশফিকের তার আগেই টেস্ট অভিষেক হয়েছিল বটে। তবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই সিরিজে তিনি দলে ছিলেন না। মানে তিনিও কালই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নামছেন প্রথম বারের মতো। মানে মুশফিকের এই দলের সব ক্রিকেটারেরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হতে যাচ্ছে কাল! স্টিভেন স্মিথের এই অস্ট্রেলিয়া দলের ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম বার টেস্ট খেলতে নামছেন স্মিথের দলের সবাই।

কিন্তু ক্যারিয়ারের এতো বছর পাড় করে দেওয়ার পরও বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট খেলতে না পারায় স্মিথদের কষ্ট থাকার কথা নয়। কারণ, নিজেদের ‘বড়’ ভেবে ‘ছোট’ বাংলাদেশকে তারা ইচ্ছা করেই এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ? মুশফিক-সাকিব-তামিমরা চাতক পাখি হয়ে অপেক্ষায় থেকেছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলার রোমাঞ্চ গায়ে মাখার জন্য। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার তাচ্ছিল্যের কারণে তাদের সেই স্বাদ পূর্ণ হয়নি। ‘ছোট’ বলে বাংলাদেশকে তারা দাওয়াত দিতে যেমন কার্পণ্য করেছে, তেমনি দাওয়াত কবুলও করেনি।

কষ্টটা মুশফিক, তামিমসহ অন্যদেরও কম না। তবে সাকিবের নামটা বলছি বিশেষ একটা কারণে। গত ৬ বছরের বেশির ভাগ সময়ই বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট অল-রাউন্ডারের খেতাবটা নিজের দখলে রেখেছেন সাকিব আল হাসান। ‘বিশ্বসেরা’ সেই সাকিবকে কেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটা টেস্ট খেলার জন্য আকুতি-বিকুতি করে ক্যারিয়ারের এক দশকেরও বেশী সময় কাটিয়ে দিতে হবে?

শুধু এড়িয়েই চলেনি, অস্ট্রেলিয়ানরা ‘ছোট’ বাংলাদেশকে অবহেলা করেছে খেলার মধ্যেও! বাংলাদেশকে মাত্র একবারই টেস্ট খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, ২০০৩ সালে। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া বাংলাদেশ তখন ‘টেস্ট পরিবারের শিশু’। তো অস্ট্রেলিয়ার মতো অভিজাত দল শিশু বাংলাদেশকে দ্রুতই দাওয়াত দেওয়ায় অন্য রকম একটা স্বস্তিই কাজ করেছিল তখন। কিন্তু সেই দাওয়াতের পরতে পরতে ছিল তাচ্ছিল্য! অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট মানেই মেলবোর্ন, পার্থ, সিডনি, অ্যাডিলেড, ব্রিসবেন…। কিন্তু ‘ছোট’ বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করে তারা টেস্ট দুটি আয়োজন করে ডারউইন ও কেয়ার্নসে। যে স্টেডিয়াম দুটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের উপযুক্তই না!

পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। ওই দুটি স্টেডিয়ামেই এ পর্যন্ত টেস্ট হয়েছে মাত্র দুটি করে! বাংলাদেশের পর ২০০৪ সালে একবার শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তাচ্ছিল্যভাবটা দেখিয়েছিল অজিরা। তবে বাংলাদেশের তুলনায় লঙ্কানদের তাচ্ছিল্য তেমন কিছু না! ২০০৩ সালের ওই সফরে দুই টেস্টের পাশাপাশি ৩টি ওয়ানডেও ছিল। এরপর ২০০৮ সালে আরও একবার ৩ ম্যাচের ওয়ানডে খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিল বাংলাদেশ। টেস্টের মতো সেই ওয়ানডের ভেন্যু হিসেবেও সেই ক্রিকেটের ‘বধ্যভূমি’ ডারউইন ও কেয়ার্নসকে বেছে নেয় অজিরা। ডারউইনের ওই স্টেডিয়ামে এ পর্যন্ত ৪টি ওয়ানডে হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সেই ৪টি ম্যাচই খেলেছে বাংলাদেশ। কেয়ার্নসেও তাই। এই মাঠে হওয়া ৩টি ওয়ানডেই খেলেছে বাংলাদেশ।

মানে বড় প্রতিপক্ষ হলে মেলবোর্ন, সিডনি, পার্থ, ব্রিসবেনের মতো মাঠ। ‘ছোট’ বাংলাদেশকে ডেকে নিয়ে খেলতে নামিয়ে দিয়েছে বধ্যভূমিতে! ভাবতে কষ্ট লাগে সেই ‘দাম্ভিক’ অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে এলে, ভেন্যু নির্বাচন করা হয় তাদের পছন্দ মতো! দেওয়া হয় সর্বোচ্চ আতিথেয়তা।

সেটা দিয়েও যদি নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক সিরিজের আয়োজন করা যেত তবু কথা ছিল। কিন্তু ‘বড় ভাই’ অস্ট্রেলিয়ার তাতেও বড় আপত্তি। এবারের সিরিজটির কথাই ধরুন। এই সিরিজটি হওয়ার কথা ছিল আরও অনেক দিন আগে। কিন্তু দাম্ভিক অজিদের পায়ে তেল ঢেলেও রাজি করানো যায়নি। নানা অজুহাতে সফর পিছিয়ে দিয়েছে।

তবে দেরিতে হলেও অস্ট্রেলিয়া এসেছে। পূর্ণ হতে যাচ্ছে সাকিব-মুশফিকদের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলার যাওয়ার স্বপ্ন। এই মহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে সাকিব-তামিমদের কী মনে হচ্ছে  না, পদে পদে অবহেলা-তাচ্ছিল্য করে যারা, তাদের একটা জবাব দেওয়া দরকার? মনে হওয়ার কথা। কারণ, আমাদের মতো আমজনতার চেয়ে কষ্টটা তাদেরই বেশী। সাকিব-তামিমরা ভালো করেই জানেন, তাচ্ছিল্য করে আসলে তাদের ক্রিকেট সমার্থকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দলগুলো। সুযোগ পেয়ে তারাও হয়তো তাই একটা উপযুক্ত জবাব দেওয়ার পরিকল্পনাই আঁটছেন।

সাকিব-তামিমরা এটাও ভালো করেই জানেন, জবাবটা দিতে হবে মাঠেই, ব্যাটে-বলে। ২০০৬ সালে ফতুল্লা টেস্টে রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল হাবিবুল বাশারের বাংলাদেশ। আরও একবার সে রকম ঝাকুনি দেওয়াটা খুব দরকার। অসিদের বুঝিয়ে দিতে হবে, তোমরা মিথ্যা অহংকারে নিজেদের বড় ভাবতে পারো, কিন্তু বাস্তবতা হলো, মাঠে আমরা তোমাদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে প্রস্তুত।

পরিশেষে অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের প্রতি তাই আকুল আবেদন রইল, মুশফিক, এই অবহেলার জবাব দেওয়া চাই। মাঠে, ব্যাটে-বলে।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :আগস্ট ২৬, ২০১৭ ৩:১১ অপরাহ্ণ