দেশের উত্তরাঞ্চলসহ ২৫টি জেলা এখন বন্যার পানিতে ভাসছে। রংপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা েেজলার প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গেছে পানির নিচে। দশের সর্বমোট ১৮টি নদ-নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চল তো বটেই কোনো কোনো জেলা শহরও এখন প্লাবিত। ওই অঞ্চলের প্রায় সবকটি নদীর পানি এখন বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, গত সোমবার বিভিন্ন নদীর পানি প্রবাহের যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তাতে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ৮১ সেন্টিমিটার, কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর পানি ১৩২ সেন্টিমিটার, গাইবান্ধার তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৭৮ সে.মি, ঘাঘট নদীর পানি ৬৪ সে.মি. সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি ৯৫ সে. মি জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ১২৫ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া, যমুনার পানি চিলমারী পয়েন্টেও সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছে। গত সোমবার পর্যন্ত ধূনট ও সারিয়াকান্দি পয়েন্টে এর পরিমাণ ছিল ৯৮ সে. মি। সিরাগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি ১০০ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত মঙ্গলবারের পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র যমুনা ও মেঘনা অববাহিকার সঙ্গে পদ্মা নদীর পানিও বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ তিনটি অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি ১৯৮৮, ১৯৮৯ ও ২০০৭ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা। এ বন্যা সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। দেশের ২৫টি জেলা বর্তমানে বন্যা কবলিত। প্রতিদিন সেসব দুর্গত এলাকার জনজীবনের দুর্দশার খবর আসছে। বন্যায় সারা দেশে শিমুসহ ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রবল পানির স্রোতের তোড়ে ভেঙ্গে গেছে অনেক বাঁধ, সড়ক এবং রেল লাইন। ফলে দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে।
বন্যার কারণ হিসেবে অতিবৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিকেই দায়ি করছেন নদী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞগণ। তারা বলেছেন, হিমালায় পাদদেশীয় অঞ্চল চীন, তিব্বত, নেপাল, ভারতের বিহার, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, এবং আসাম, অরুনাচল, মেঘালয়সহ উত্তর পূর্ব ভারতের সাত পার্বত্য রাজ্যের উজানভাগের অববাহিকা থেকে ভয়ানক আকারে বাংলাদেশের দিকে নেমে আসছে ঢলের পানি। যা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, মেঘনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদী সমূহকে অস্বভাবিকভাবে প্লাবিত করে ফেলছে। ভারতের গজলডোবা বাঁধের সবগুলো গেইট খুলে দেয়ার ফলে তিস্তানদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
এদিকে বৈশ্বিক বন্যা পূর্বাভাস প্রদানকারী আন্তর্জাতিক দুইটি সংস্থা জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক কার্যালয়-ইউএন আর সিও এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ গবেষণাকেন্দ্র জেআরসি গত ১০ আগস্ট পৃথক সতর্কবার্তায় জানিয়েছিল, বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ভূটান ও নেপালে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকার উজানের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ভাটিতে বাংলাদেশের দিকে গড়াতে থাকবে। যা ২শ’ বছরেরও বেশিকালের বন্যার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া অপর একটি সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ১০ দিনে হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ভারত ও বাংলাদেশের প্রান্তে পানি বৃদ্ধি পাবে।
বন্যায় কবলিত এলাকার মানুষের দুর্দশার খবর প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে উঠে আসছে। ঘর-বাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন জেলায় গৃহহারা মানুষের সড়ক-মহাসড়ক, বাঁধ কিংবা রেল সড়কে আশ্রয় নেয়ার সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছে। খাদ্য এবং বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে। এমনকি মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার মতো শুকনো জায়গারও অভাব দেখা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাব এ স্বজনের লাশ নিয়ে আহাজারির খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনাটি লালমনিরহাট সদর উপজেলার পূর্ববড়–য়া গ্রামের। বন্যার পানির প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়া আবু হানিফ, মোজামউদ্দিন, আসমা বেগম ও শিশু নাদিমের মৃত দেহ উদ্ধারের পর তা দাফন করতে না পেরে মাতম করছিলেন স্বজনরা। অবশেষে কয়েক মাইল দূরে আত্মীয় বাড়িতে তাদেরকে দাফন করা হয়। খবরে বলা হয়েছে, বন্যায় কবরস্থান তলিয়ে যাওয়ায় লাশ দাফন করতে পারছে না মানুষ। অসহায় মানুষ পাঁচ দশমাইল দুরের গ্রাম বা পাশ্বর্তী জেলায় নিয়ে লাশ দাফন করছে।
বন্যার করাল গ্রাসে পতিত মানুষদের অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার খবর এখন সর্বজনবিদিত। কিন্তু অসহায় মানুষগুলোকে রক্ষায় সমন্বিত কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়ে উঠছে না। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা কোথাও কোথাও শুরু হলেও তা অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। বানভাসী মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। বন্যা কবলিত জেলাগুলোকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি ত্রাণ কার্য পুরোদমে শুরু করা দরকার বলে আমরা মনে করি। একই সঙ্গে দেশের সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও বিত্তবান ব্যক্তিদেরও অসহায় মানুষদের দিকে সহানুভূতির হাত প্রসারিত করা দরকার। রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি নয়, এখন প্রয়োজন আর্ত মানুষের সেবায় একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়া।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ খুবই জরুরি। বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত পানি ধারণ এবং সাগরের দিকে প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য নদ-নদী ও খালের নাব্যতা রক্ষা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের নদ-নদী ও খাল দীর্ঘদিন খনন হয় না। পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষার অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে পারে না। নদ-নদী ভরাট হওয়া বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞগণ ইতোমধ্যেই অভিমত দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান তাঁর আমলে সারা দেশে ১৪ শত খাল খনন পুনঃখনন করেছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন আর খাল খনন করা হয়নি। ফলে কয়েক বছর পর পরই বন্যার কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাল খনন কর্মসূচী যে কতোটা দূরদশী বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা ছিল তা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যাচ্ছে। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করলে হলে নদ-নদী- খাল খননের বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে রাজনীতিকে সংকীর্ণতা পরিহার করে জাতীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।