নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রতিবছরই বাড়ছে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বজ্রপাত একটি সাধারণ ইস্যু হলেও এশিয়া মহাদেশে এর প্রভাব সবচেয়ে প্রকট। বজ্রপাতের কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে বজ্রপাতে যতজন মারা যাচ্ছে, তার চার ভাগের এক ভাগই বাংলাদেশে। গত জুলাই মাসে রেকর্ড করা তথ্য অনুযায়ী বজ্রপাতে সারাদেশে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১৫৫ জন মারা গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত বছরে দেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ১২৫৫ জন। ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন এবং চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৫৫ জন বজ্রপাতে মারা গেছে।
ইতিমধ্যে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু এখনো এটি প্রতিরোধের কোনো উপায় বের করা সম্ভব হয়নি। বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত দেয়ার কৌশল বিজ্ঞানীরা এখনও উদ্ভাবন করতে পারেননি। তাই এক রকম আতঙ্কের মধ্যেই রয়েছে দেশের মানুষ।
তবে বজ্রপাতে আহত ব্যক্তির সংখ্যা কত তার কোনো হিসেব নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বনভূমি উজাড় হওয়ার কারণেই বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটছে।
বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ সংক্রান্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যপঞ্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার প্রতি কোটিতে ৪ জনের কম। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একমাত্র ভারত ছাড়া সব দেশে এই হার অনেক বেশি। পরিসংখ্যান মতে, বজ্রপাতে বছরে কোটি জনের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় মৃতের সংখ্যা ২৭ জন, নেপালে ২৪ জন। বাংলাদেশে এই হার প্রতি কোটিকে ৯ জন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছর সরকার এটিকে অন্যতম দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়। বজ্রপাতে নিহতের পরিবারকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২০ হাজার টাকা দিয়ে থাকে।
কিন্তু আশঙ্কার কথা হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত দেয়ার কৌশল এখনও উদ্ভাবন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। ফলে এটি ভয়ঙ্কর একটি বিষয় হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। যার বড় শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এমনকি বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে বজ্রপাতে যত মৃত্যু হয়েছে তার প্রায় এক চতুর্থাংশ ঘটছে বাংলাদেশে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ভারসাম্য এবং এই শক্তি অক্ষুন্ন রাখতে বজ্রপাত প্রাকৃতিক চার্জের কাজ করে। বজ্রপাত প্রতিরোধ করা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রকৃতিও বজ্রপাত বাড়িয়ে মাধ্যাকর্ষণের ভারসাম্য ঠিক রাখছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ‘বাংলাদেশ আগে ছিল ছয় ঋতুর দেশ। বলতে গেলে এখন আর ছয় ঋতু নেই। শীতের সময় শীত নেই, গরমের সময় গরম নেই। আগাম বৃষ্টি, আগাম বন্যা, আগাম শীত। বজ্রপাত নিরোধকারী ও আগাম সংকেত প্রদানযোগ্য যন্ত্রাংশ ভিয়েতনাম থেকে আনা হচ্ছে। এগুলো এলে নির্ধারিত প্রকল্পের অধীনে বজ্রপাত নিরোধে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শুরু হবে।’
তিনি বলেন, দেশের ফাঁকা অঞ্চলে ১০ লাখ তাল গাছ লাগানোর কাজ চলছে। এ ছাড়া ব্যাপক বনায়নও বজ্রপাতের ঝুঁকি হ্রাসের পক্ষে কার্যকর বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। সে কাজেও পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকেও বনায়নে কাজ করা হবে।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে৷ তাই জাতিসংঘের পরবর্তী জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনে বিষয়টি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সবচেয়ে জরুরী বিষয় হচ্ছে, বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য সচেতনতা দরকার।
দৈনিকদেশজনতা/এন এইচ