নিজস্ব প্রতিবেদক:
পিছিয়ে পড়তে থাকা দেশের রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ বা মুক্তবাণিজ্য অঞ্চলের (বেপজা) পালে আবার নতুন করে হাওয়া লাগছে। এ অঞ্চলের পরিধি বাড়িয়ে পিছিয়ে যাওয়ার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাই তৎপর হয়ে উঠেছে সরকার। লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের। বর্তমানে আটটি অঞ্চলে চলছে ইপিজেডের কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে ইপিজেড অঞ্চলগুলো আধুনিকায়ন করাসহ যুক্ত করা হবে সড়ক-মহাসড়কের সঙ্গে। যাতে পণ্য-পরিবহনে আসে নতুন গতি এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও গুণগত মান দেখে এখানে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়।
সরকার আশা করছে, ইপিজেডের পরিধি বাড়ালে অর্থনীতির চাকা যেমন একদিকে সচল হয়ে উঠবে; অনুরূপভাবে বেকারত্ব সমস্যারও সমাধান হবে। এসব অঞ্চল স্থাপনের পর রফতানি প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রমের পালে হাওয়া লাগার পাশাপাশি কর্মসংস্থান হবে কোটি মানুষের। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা ইপিজেড সম্প্রসারণের মাধ্যমে সে গন্তব্যে পৌঁছাতে কিছুটা সহায়ক হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারের ক্ষেত্রে ইপিজেডগুলোর ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের বিনিয়োগমুখী নীতি ও কৌশল গ্রহণের ফলে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ মানচিত্রে ক্রমেই মোট বিনিয়োগের সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানে দিন দিন বাড়তে থাকে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ। পথ প্রশস্ত হয়েছিল ব্যাপক কর্মসংস্থানের। কিন্তু একসময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে ধস নামা শুরু হয় এই ব্যবসায়।
এ ছাড়া ঢাকার আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডে আগুনে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির কারণে আতঙ্কে অনেকেই চাকরি পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যায়। এর সঙ্গে জীবনমানের ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে বেতন কাঠামোর মিল না থাকায় ইদানীং ইপিজেডগুলোয় সেভাবে চাকরিপ্রত্যাশীদের আগ্রহী হতে দেখা যায় না। একই কারণে কর্মস্থল পরিবর্তনের হিড়িকও আগের চেয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। ফলে কারখানাগুলোয় পদ থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বেপজার এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে বেপজার আওতাধীন আটটি ইপিজেডে সর্বমোট কর্মসংস্থান হয়েছিল ৩৩ হাজার ৫৯৮ জনের। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাত্র ১০ হাজার ২৪২ জন শ্রমিক নতুন করে যোগ হয়েছে ইপিজেডে। হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে কর্মসংস্থানের গতি কমে গেছে সরকারি ইপিজেডগুলোয়। মূলত ইপিজেডে খালি প্লট না থাকায় নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়াও একটি কারণ। এর আগের বছরের চিত্রও আশাব্যঞ্জক ছিল না। অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারি ইপিজেডে সর্বোচ্চ ৪৩ হাজার ৬৬৬ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছিল।
দেশে রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশসহ নানা কারণে সম্প্রতি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংখ্যা বাড়াতে মনোযোগী হয়ে ওঠে সরকার। এ বিষয়ে সব কার্যক্রম চলছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই। এ সুযোগে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে ইপিজেড এলাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগও নড়েচড়ে বসে। গত ২৬ জুলাই অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনাও প্রস্তুত করেছে এ বিভাগটি। সেখানে বলা হয়, সরকার আগামী ১৫ বছরে দেশে ইপিজেড অঞ্চলের সংখ্যা ১০০টিতে উন্নীত করার আগে সড়ক-মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে ডিপিপি প্রণয়ন করাই শ্রেয়। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের পণ্য-পরিবহনসহ সামগ্রিক কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে। তাই জাতীয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নাধীন এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংযোগস্থলে এটি-গ্রেড অথবা গ্রান্ট সেপারেট অবকাঠামো নির্মাণ করা। পাশাপাশি বেপজার আওতায় বাস্তবায়নাধীন সর্ববৃহৎ মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রবেশ-নির্গমনের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে একটি সংযোগ সড়ক ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অতিরিক্ত সচিব ড. এ এম এমদাদুল হক স্বাক্ষরিত পত্রটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বরাবর প্রস্তাব পাঠায়।
বেপজা সূত্র মতে, বাংলাদেশ ছাড়াও ইপিজেডভিত্তিক শিল্পাঞ্চলে এখন পর্যন্ত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, চীন, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, তুরস্ক, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, ইউক্রেন, মার্শাল আইল্যান্ড, মরিশাস, আয়ারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, পানামা, নেপাল, পাকিস্তানসহ মোট ৩৩টি দেশের বিনিয়োগ হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিধি বাড়লে নতুন নতুন দেশ বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইপিজেডসমূহ বিদেশি বিনিয়োগের আকর্ষণে মডেল হিসেবে কাজ করছে। উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের জন্যও এর প্রতিষ্ঠান অনুকরণীয় হয়ে উঠছে। আধুনিক বিশ্বে বিদেশি ক্রেতারা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্সের ওপর জোর দিচ্ছে। তাই ইপিজেডভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বিদেশি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব প্রতিষ্ঠানেও সোশ্যাল কমপ্লায়েন্সের বিভিন্ন শর্ত মেনে চলার চেষ্টা করছে। ফলে ইপিজেডে কর্মপরিবেশ অন্য কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক উন্নত। ইপিজেডগুলোর সঙ্গে সড়ক-মহাসড়ক সরাসরি যুক্ত হলে কর্মপরিবেশ আরো উন্নত হবে। উল্লেখ্য, দেশে বিদ্যমান ইপিজেডগুলো চট্টগ্রাম, ঢাকা, মংলা, কুমিল্লা, ঈশ্বরদী, উত্তরা (নীলফামারী), আদমজী ও কর্ণফুলী এলাকায় অবস্থিত।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ