নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় চিকুনগুনিয়া মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে। মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, মহামারি হোক আর যাই হোক; এজন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) দায়ী নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকুনগুনিয়ার বিস্তারের জন্য সিটি করপোরেশনগুলোর ব্যর্থতাকে দায়ী করলেও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ডিএনসিসি মেয়র। এদিকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, চিকুনগুনিয়ায় চিকিৎসায় শুধু প্যারাসিটামলের কথা বলা হলেও কোনো কোনো চিকিৎসক একাধিক ওষুধ ব্যবহার করছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগে শুধু প্যারাসিটামল এবং প্রচুর পরিমাণ পানি ও তরল খাবার খেতে হবে।
মশাবাহিত ভাইরাস জ্বর চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শুক্রবার সকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে এক টুইটের মাধ্যমে তিনি এ আহ্বান জানান। টুইটে খালেদা জিয়া লিখেন, চিকুনগুনিয়া আক্রান্তদের দ্রুত সুস্থতার জন্য দোয়া করছি। সেই সঙ্গে সরকারকে এ রোগ প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। শুক্রবার ডিএনসিসির এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক এপিডেমিওলজিস্ট অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, মহামারি হচ্ছে একটি রোগের যে অবস্থান থাকে সেটি তার অবস্থান থেকে নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট একটি স্থানে অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে। সে মোতাবেক বর্তমান সময়ে চিকুনগুনিয়াকে মহামারি বলা যায়। এটি আমার ব্যক্তিগত মত। এটিকে মহামারি ঘোষণা করার অথরিটি রয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের জন্য দুই সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে বলেন, তাদের অদক্ষতায় রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া রোগের বিস্তার ঘটছে। তিনি আরও বলেন, রাজধানী পরিষ্কার রাখা আমাদের কাজ নয়। রাজধানী পরিষ্কার রাখতে এবং মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতার অভাবে নগরীতে চিকুনগুনিয়া রোগের বিস্তার।
সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আনিসুল হক বলেন, মহামারি হোক আর যাই হোক; এর জন্য কোনোভাবেই সিটি করপোরেশন দায়ী নয়। এর আগে এ বক্তব্যের পক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরে মেয়র বলেন, যে এডিস মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া ছড়ায়, তা ড্রেন, ময়লা-আবর্জনা কিংবা জলাশয়ে বংশ বিস্তার করে না। এডিস মশা মূলত বাসাবাড়ির ফ্রিজ ও এসির ট্রে, ফুলের টব, ছাদে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। এছাড়া পড়ে থাকা ভাঙা হাঁড়ি, ক্যান, পরিত্যক্ত টায়ার ও বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবনে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা এ মশার বংশ বিস্তারের অন্যতম কারণ। এক পর্যায়ে মেয়র বলেন, চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার জন্য যেভাবে সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা হচ্ছে, সেটার কোনো ভিত্তি নেই। কারণ, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মশা মারা সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া ঢাকার এমন অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে গিয়ে সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে জনগণের সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আক্রান্তদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ ও সমবেদনা জানাই।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। শুক্রবার বিকালে নগরভবনে আয়োজিত চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে স্পেশাল ক্রাশ প্রোগ্রামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ ঘোষণা দেন। এর আগে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে মশক নিধন কাজে নিয়োজিত ৩০৩ স্প্রে ম্যান, ১৪৮টি ফগার এবং ২৭১টি হস্তচালিত মেশিন দিয়ে পরিচালিত মশক নিধন কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন এবং অঞ্চল-৪ এ চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে স্পেশাল ক্রাশ প্রোগ্রামের উদ্বোধন করেন মেয়র সাঈদ খোকন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, চিকুনগুনিয়া কোনো ঘাতক রোগ নয়। মশাবাহিত জীবাণুর মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। তিনি বলেন, যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা এবং সব মন্ত্রণালয়, সরকারি মেডিকেল কলেজের ১০ হাজার ছাত্র ও কর্মচারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সভা-সমাবেশ করে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ রোগ প্রতিরোধে আমরা গত তিন মাস ধরে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।
চিকুনগুনিয়া চিকিৎসা বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, চিকিৎসা নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো কারণ নেই। আমরা সব হাসপাতালে চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত গাইডলাইন পাঠিয়েছি। এছাড়া চিকিৎসক-নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি মোকাবিলায় হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে। এছাড়া চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধির ব্যথা প্রশমনে প্রতিটি হাসপাতালে প্রয়োজনে জয়েন্ট পেইন ক্লিনিক বা আর্থালজিয়া ক্লিনিক খোলারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখান থেকে রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি বা ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হবে। দেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলা ও উপজেলা হাসপাতালেও এ সেবা দেয়া হবে। এর আগেই চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার (চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) খোলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চিকুনগুনিয়া যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে এটা মহামারি কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই ঢাকায় এ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর থেকে প্রতি মাসেই আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীর মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীর ভিড় বাড়তে থাকে এ বছরের এপ্রিল থেকে। ভিড় বাড়তে থাকে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও।
আক্রান্তদের বড় অংশ শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। কিন্তু তারপরও সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী- কেউই এটাকে মহামারি বলতে রাজি নন। বরং চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক দুইজনই মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের ‘ব্যর্থতাকেই’ দায়ী করেন।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ