২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:০৫

অবসরে গেলেন দেশের প্রথম নারী বিচারপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

অবসরে গেলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রথম ও একমাত্র নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। প্রথা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসে আপিল বিভাগে এই বিচারপতিকে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে বিদায় সংবর্ধণা দেয়া হয়। এছাড়া বিকালে জাজেস লাউঞ্জে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা জানানো হয়। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা শুধু উচ্চ আদালতের নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারকও।

বার এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়েরর সংবর্ধণা প্রদান অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি ছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগের পাঁচ শতাধিক সিনিয়র ও জুনিয়র আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের পক্ষ থেকে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন অ্যার্টনে জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সভাপতি জয়নুল আবেদীন এ নারী বিচারপতির বর্ণাঢ্য কর্মময়জীবন নিয়ে বক্তব্য রাখেন।

দুপক্ষের বক্তব্য শেষে বিচারপতি নাজমুন আরা নিজের ৪২ বছরের বিচারিক জীবনের নানা স্মৃতি-অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, প্রায় ৪২ বছরের বিচারকের জীবন শেষ হলো আজ। বিচার করার কঠিন কাজ ও বিচারকের সীমাবদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার আগ্রহ ছিল আমার। আজকের এ ক্ষণটিতে আমার কষ্ট হচ্ছে এই বিচারঙ্গন থেকে বিদায় নিতে আপনাদের ছেড়ে যেতে।

তিনি আরো বলেন, আল্লাহ আমাকে বিচারক বানিয়েছেন, এ দেশের প্রথম নারী বিচারক। তবে আমার বিচারক হওয়ার পেছনে আমার মরহুম আব্বার ইচ্ছা ও আম্মার প্রেরণা বড় ভূমিকা রেখেছে।

১৯৭২ সালের আইনজীবী পেশার প্রথম দিন কোর্টের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বোধহয় আমার মনের কোনায় ইচ্ছাটা উঁকি দিয়েছিল, আমি কি জজ হতে পারি না? কিন্তু জানলাম আমি জজ হতে পারি না। ওই সময় বাংলাদেশের নারীরা জজ হতে পারত না। আমি ওকালতি করার বছর দেড়েক পরে ওই বিধান সরকার তুলে দেয়।

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে দেশের প্রথম নারী বিচারক হয়ে খুলনার জজশিপে মুন্সেফ হিসেবে যোগদান করি। ওই সময় খবরের কাগজে এটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল। প্রতিক্রিয়া দু’রকমেরই হয়েছিল। কেউ স্বাগত আবার অনেকে নাক সিঁটকেছিলেন নারী আবার বিচারক হতে পারে নাকি? নারী আবার কি বিচার করবে? কর্মক্ষেত্রেও আমি এই দু’রকমের আচরণ পেয়েছিলাম।

সুদীর্ঘ বিচারক জীবনে কখনই জেনে-বুঝে বা অবহেলায় বা অমনোযোগী হয়ে কোনো ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার করিনি উল্লেখ করে দেশের এ প্রথম নারী বিচারপতি বলেন, আমার অনেক বিচারই হয়তো ভুল হয়ে গেছে, আপিলে গিয়ে হয়তো সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু সে ভুল বিচার আমি জেনে-বুঝে বা অমনোযোগী হয়ে করিনি। জেনে-বুঝে অবিচার করা বা অমনোযোগী হয়ে বা অবহেলা করে ভুল বিচার করা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। পক্ষাশ্রিত হয়ে বা কোনো কারণে বা কারও দ্বারা প্রভাবান্নিত হয়ে বিচার করা মহাপাপ। আমার আত্মতৃপ্তি আমি জেনে বুঝে বা অবহেলা করে বা অমনোযোগী হয়ে বা পক্ষাশ্রিত বা প্রভাবান্নিত হয়ে ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার কখনোই করিনি।

১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন নাজমুন আরা সুলাতানা। মায়ের চাকরির সুবাধে তার শৈশব কেটেছে ময়মনসিংহে। শিক্ষাজীবনও কাটিয়েছেন সেখানেই। ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন নাজমুন আরা সুলতানা। ১৯৬৯ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বিএসসি পাস করার পর ময়মনসিংহ ‘ল’ কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ময়মনসিংহ জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে আইন পেশা শুরু করেন ১৯৭২ সালে। এরপর ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ হিসেবে (সহকারী জজ) নিয়োগ পান। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি।

২০০০ সালের ২৮ মে নাজমুন আরা সুলতানা হাইকোর্টে অতিরিক্ত ও ২০০২ সালের ২৮ মে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে নাজমুন আরা সুলতানা ফতোয়া বিষয়ক মামলা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ির মামলা, চারদলীয় জোট সরকার আমলে বাদপড়া ১০ বিচারপতির মামলা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত বিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা এবং উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়ক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বিচারক ছিলেন।

নারী বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডব্লিউজেএ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাজমুন আরা সুলতানা। এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক নারী আইনজীবী সংস্থায় দু’বার সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা সুদীর্ঘ কর্মজীবনে ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইতালি, জাপান, আমেরিকা, চীন, ইরান, ইরাক, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, পানামা ও হংকং সফর করেন।

দৈনিক দেশজনতা /এমএম

প্রকাশ :জুলাই ৬, ২০১৭ ৭:১০ অপরাহ্ণ