শাহ আলম, রাঙামাটি:
রাঙামাটির লংগদুতে বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনায় সর্বশেষ এ পর্যন্ত ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সবার অভিযোগ কিছু কুচক্রির উস্কানিতে ওই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ঘটনার এক মাসেও আসল উস্কানিদাতা কাউকে আজও শনাক্ত করা যায়নি। তবে দোষী সবাইকে খুঁজে বের করতে তদন্ত জোরদার রয়েছে বলে জানান, লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মমিনুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, স্থানীয় যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ উদ্ধারকে কেন্দ্র করে ২ জুন লংগদু উপজেলা সদরের তিনটি পাহাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে ভস্মীভূত হয় পাহাড়িদের দুই শতাধিক বাড়িঘর।
লংগদু থানার ওসি জানান, ওই ঘটনায় মূল মামলা হয়েছে দু’টি। ঘটনার দিন লংগদু থানায় পুলিশ বাদী হয়ে প্রথম মামলাটি দায়ের করে। এ মামলায় ১৫ জনের নাম উল্লেখসহ ৩০০-৪০০ জনকে আসামি দেয়া হয়েছে। পরে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে বাদী হয়ে একই থানায় আরও একটি মামলা দেন কিশোর কুমার চাকমা। তার মামলায় ৯৮ জনের নাম বিস্তারিত উল্লেখসহ ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলা দু’টি তদন্তাধীন। এ পর্যন্ত ৩০ জনকে গ্রেফতার করে আইনে সোপর্দ করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রিমান্ডে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছে গ্রেফতারকৃত আসামিরা। তবে তদন্তের স্বার্থে এসব তথ্য এখন প্রকাশ করা যাবে না।
ঘটনার উস্কানির মূলে কাউকে শনাক্ত করা গেছে কিনা জানতে চাইলে মামলা দু’টির আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) ওসি মমিনুল ইসলাম বলেন, সবকিছুর যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। ঘটনার পেছনে ইন্ধন ও উস্কানির অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত চলছে। তবে এখনও কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। অগ্রগতি রয়েছে।
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত যেই হোক- কারও ছাড় নেই। বিস্তারিত যাচাই বাছাই ও তদন্তসহ ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। পুলিশ নিরীহ নিরপরাধ কাউকে কোনো হয়রানি করছে না।
এদিকে ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, নয়ন হত্যাকে ঘিরে সেখানকার স্থানীয় কতিপয় কুচক্রির ইন্ধন ও উস্কানিতে লংগদুতে নিরীহ পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। অথচ তাৎক্ষণিক খাগড়াছড়ি থানায় নয়ন হত্যার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। ফলে এরমধ্যেই ওই হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনে দিয়েছে পুলিশ।
খোদ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা দাবি করছেন, সরকারে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে কিছু কুচক্রির ইশারা-ইন্ধনে পাহাড়িদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। বিভিন্ন জনে যদিও সন্দেহ করে এর পেছনে বিএনপি-জামায়াতের লংগদুর কিছু কুচক্রী জড়িত। কিন্তু তারা আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ বিষয়ে জেলা যুবলীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও লংগদুর স্থানীয় বাসিন্দা শাহ নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন আমরা যখন জানাজা শেষে নয়নের লাশ দাফন-কাফনের চেষ্টায় ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তে ‘আমরা লংগদু উপজেলাবাসী’ ব্যানারে শোক মিছিলের নামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করা হয়। ততক্ষণেই ওই মিছিল থেকে নিরীহ পাহাড়িদের বাড়িঘরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। মিছিলটির নেতৃত্বে জামায়াত-বিএনপির বহু নেতাকর্মীকে দেখা গেছে। বিভিন্ন জনে অভিযোগ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও জানাজায় ও মিছিলে ছিলেন কিন্তু গ্রেফতার করা হচ্ছে বিএনপি জামায়াতের লোকজন।
তিনি জানান, মিছিলের সামনে লংগদু উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন এবং জামায়াতের লংগদুর আমীর ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা নাছির উদ্দিনসহ বিএনপি-জামায়াতের অনেকে ছিলেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য, লংগদুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা। তাই ঘটনার পেছনে যাদের পরোক্ষ প্রত্যক্ষ ইন্ধন-উস্কানি ছিল তাদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি করে এই যুবলীগ নেতা বলেন, অন্যথায় যে কোনো মুহূর্তে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। ঘটনার উস্কানির মূলে কুচক্রিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
লংগদু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল বারেক সরকার বলেন, ঘটনাটির পেছনে অবশ্যই কুচক্রির ইন্ধন ও উস্কানি রয়েছে। যা পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটানো হয়েছে। উস্কানিদাতাদের চিহ্নিত করে তাদেরকে আইনের আওতায় কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নচেৎ ভবিষ্যতে আরও অঘটন ঘটানোর সাহস পাবে।
এদিকে ঘটনার সময় নিরাপদে চলে যাওয়া লোকজন পোড়াবাড়ির ভিটায় ফিরে বর্তমানে লংগদু সদরের তিনটি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আজও দুর্বিষহ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা পুনর্বাসনের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। আজও ধ্বংসস্তুপে পড়ে রয়েছে পোড়াবাড়ির ভিটাগুলো।
এ ব্যাপারে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা বলেন, সরকার লংগদুর অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের মাঝে খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রয়েছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএম