শিল্প–সাহিত্য ডেস্ক:
উড়ে যাচ্ছে নীল মেঘ। পার্কের কাশফুলও মৃদু হাওয়ায় দুলছে। সেই কাশফুলের মতো করে বাতাসে দুলছে নীলার চুল। দীঘল কালো চুলগুলো পার্কের বেঞ্চের নিচে ঝুলছে। হাল্কা রোদ লেগে চুলগুলো রেশম কালো লাগছে। এতো বড় চুল নীলার ভালো লাগে না। কিন্তু উপলের ভীষণ প্রিয় বড় চুল। তাই নীলা তার প্রিয় বয়কাট চুলগুলোকে এতো বড় করেছে। শুধু উপলের জন্য। উপলের ভালো লাগাকে সম্মান দেওয়ার জন্য নীলার এই সাধনা। ঘড়ির কাঁটাটা ছুটেই চলছে। বিরক্তিমাখা মুখে নীলা তাকাচ্ছে চারিদিকে। আজ কতো গুরুত্বপূর্ণ দিন। অথচ উপলের কোন খোঁজ নেই। এতো দেরী করছে।
বাদামওয়ালা : আফা, বাদাম লন। স্যার আইয়া পড়বো। মনে কষ্ট লইয়েন না।
নীলা : না ভাই, বাদাম লাগবে না। তুমি যাও। হঠাৎ ছেঁড়া জামা পরে সামনে এলো ছোট্ট একটি মেয়ে। ধূলায় জট বেঁধে গেছে চুলে। দুই পা ভর্তি কাদা। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো, ‘মেডাম, আপনি কি ছ্যাকা খাইছেন? একা একা পার্কে বইয়া আছেন?’
রাগে লাল হয়ে উঠলো নীলার দুই চোখ। বিরক্তিতে বেঞ্চ ছেড়ে ঘাসের উপর বসল। বিকালটা বিদায় নিয়েছে। পাখিগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে বাসায় ফেরার।
ওহ! কি যে বিরক্ত লাগছে! উপল ফোন রিসিভ করছে না। হয়তো জ্যামে বসে আছে। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আলতো করে ধরলো নীলার দুই চোখ। পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ! আধুনিকতা আর ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল নীলার উপল। নীলা মুহূর্তেই বুঝে ফেলল, এই প্রিয় আঙুলগুলো কার।
নীল : আমি যাচ্ছি। গুড বাই। তুমি অন্য মেয়ের কাছে চলে যাও।
উপল : প্লীজ নীল, এমন করো না। অফিসে মিটিং ছিলো। রাস্তায় ভয়ানক জ্যাম। তুমি এতোবার ফোন করেছ, আমি বুঝতেই পারিনি। আমি দুপুরে খাবার খাওয়ার সময় পাইনি। এখন সন্ধ্যা ৬টা।
নীলা : হায়! হায়! চলো আগে কিছু খাবা।
উপল : না, কিছুই খাবো না। অন্য মেয়ের কাছে যাবো।
নীলা : তার মানে?
উপল : তুমি যে বললা, গুড বাই। আর অন্য মেয়ের কাছে যেতে।
নীলা : সেটা তো অভিমান করে বলেছি। মন থেকে বলিনি।
নীলার খুব সুন্দর হাসির কাছে পরাজিত হলো উপল। দু’জনে হাত ধরে বের হয়ে গেল পার্ক থেকে।
দ্বিতীয় দৃশ্য
উপল : এতো কষ্ট করো না তো। ছেলেরা মেয়েদের বাসায় যায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আর ওরা আসবে আমাদের বাসায়। এতো রান্না করার কিছু নাই।
মহতী বেগম : এতো ধনী মানুষ আমার বাসায় আসবে। এতো আমার ভাগ্যের ব্যাপার। আমার এই টিনের বাড়িতে তারা আসবে।
উপল : মা, নীলা আমাকে মানুষ হিসেবে পছন্দ করেছে। আমাদের টাকা-পয়সা দেখে না। তোমার ছেলে এতো গুডবয় যে, নীলা তার বাবার প্রাসাদ ছেড়ে এই টিনের ঘরে স্বেচ্ছায় থাকতে প্রস্তুত। শুধুমাত্র তোমার গুড বয়ের জন্য।
কথা শুনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন উপলকে। আনন্দে ভিজে উঠল মায়ের দুই চোখ। হঠাৎ বেজে উঠল কলিং বেল। উপল দরজা খুলল।
নীলার বাবাকে দেখামাত্রই ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন মহতী বেগম। তার হাত থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। হাত থেকে ছিটকে পড়লো মাংসের বাটি। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলেন ৪৩ বছরের না বলা সব কথা।
নীলার বাবা একজন রাজাকার। মহতী বেগমকে মুক্তিযুদ্ধের সময় তুলে দেন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। মহতী বেগম জানেন না উপল কার সন্তান। কী তার পিতৃপরিচয়? মুহূর্তেই মাথায় আকশ ভেঙে পড়লো উপলের। উপলের হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। লজ্জা, ঘৃণায় বাকশূন্য হয়ে পড়লো উপল। এই সমাজে যার এতো সম্মান, এতো বছর ধরে গড়ে তোলা ক্যারিয়ার তা মুহূর্তে ধূলায় মিশে গেল। কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা গেলেন মহতী বেগম।
শেষ দৃশ্য
অফিস থেকে ফেরার পথে হতবাক হলো উপল। নীলাদের প্রাসাদসম বাড়ির দরজায় কিসের এতো ভিড়। রক্ত জমাট বেঁধে গেল উপলের। এ কী দেখছে সে। নীলা আট তলা বাসার ছাদের উপর থেকে কিছুক্ষণ পূর্বে লাফ দিয়েছে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে তার মাথা, লাল সিঁদুর হয়ে গেছে তার দীঘল কালো চুল। উপল চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বসে পড়ল রক্তে ভেজা মার্বেল পাথরের মেঝেতে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এ তুমি কী করলে নীলা, এ তুমি কী করলে নীলা, কেন এমন করলে? তোমার তো কোন অপরাধ ছিল না।’
কে একজন উপলের হাতে গুঁজে দিল একটি চিরকুট। তাতে নীলার হাতের লেখা, ‘আমায় ক্ষমা কর উপল। আমার বাবা একজন রাজাকার, তার এই লুটপাটের সাম্রাজ্যে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তোমার মায়ের সাথে আমার বাবা যা করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই মুখ আমি পৃথিবীকে কিভাবে দেখাবো উপল? আমায় তুমি ক্ষমা করো।’
শক্ত পাথর হয়ে গেল উপল। দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বসে রইল নীলার নিথর দেহের পাশে। বাড়তে শুরু করল উৎসুক জনতার কোলাহল। নীল কষ্টে বাকরুদ্ধ হয়ে রইল উপল।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ