রাঙামাটি প্রতিবেদক:
স্বজনদের হারিয়ে বিলাপ থামছে না পঞ্চাষোর্ধ গৃহকত্রী হোসনে আরার। তাদের বসত ঘরবাড়ি ছিল রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর পশ্চিম মুসলিম পাড়ায়। সেখানে স্বামী, সন্তান আর নাতনি নিয়ে ছিল তার গোছানো সংসার। পাশে গরুর ঘরও ছিল। ১৩ জুন রাঙামাটির সর্বকালের সর্বনাশা পাহাড় ধসের বিপর্যয়ে সব হারিয়েছেন তিনি।
সেইদিন নিষ্ঠুর প্রকৃতি সবকিছু কেড়ে নিয়েছে গৃকত্রী হোসনে আরা আক্তারের। পাহাড়ের মাটির চাপায় বিলীন হয়ে গেছে তাদের বাড়িঘর। এখন বাড়িঘরের কোনো চিহ্ন নেই। সেখানে মাটির চাপায় প্রাণ গেছে স্বামী আবদুল জলিল (৬০), ছেলে আলমগীর (২৮), ইশতিয়াক আহমেদ টিপু (২০), মেয়ে নরুন্নাহার আক্তার ময়না (২২) ও নাতনি (আলমগীরের মেয়ে) আলিফার (৫)।
পরিবারের পাঁচ স্বজন হারিয়ে হোসনে আরা এখন পাগলপ্রায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন ৭ জনের ওই পরিবারের কেবল দুইজন। তারা হলেন- গৃহকত্রী হোসনে আরা ও তার আরেক ছেলে আউয়াল হোসেন মোস্তফা (২৪)।
হোসনে আরার সঙ্গে কথা হয় শুক্রবার রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী মুসলিমপাড়ার তার বাবা নজির আহমদের বাড়িতে। দুর্ঘটনার দিন বোন হোসনে আরাকে উদ্ধার করে তাদের বাড়ি নিয়ে যান তার ভাইয়েরা। দুর্যোগে শারিরীকভাবে গুরুতর আহত হোসনে আরা এখনও অসুস্থ। বিকারগ্রস্ত মানসিক অবস্থাও।
কথা বলার জন্য তাকে ধরাধরি করে এই প্রতিবেদকের সামনে নিয়ে আসেন তার ভাই নুর হোসেন, নুরুল ইসলামসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। এ সময় কান্না আর বিলাপজুড়ে ফেটে পড়েন স্বজনহারা ওই গৃহকত্রী। কিছুক্ষণ উচ্চস্বরে বিলাপের পর থেমে যান। অশ্রু ঝরা চোখে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন অসহায় দৃষ্টিতে।
পরে নিরবতা ভেঙে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে আবার বিলাপ জুড়ে দেন হোসনে আরা। বলেন, আমার কাছে কেন এসেছেন ? আমার ছবি তোলে কী করবেন ? আমার তো কেউ নেই। কিছু নেই। ময়না (তার মেয়ে) কলেজে যেত। কলেজ থেকে ফিরে বলত, মা আমাকে খেতে দাও। আলিফা (নাতনি) ‘দাদি দাদি’ বলে সারাক্ষণ পিছে পিছে ঘুরঘুর করত। শুনতে পেতাম সন্তানদের ‘মা’ ডাক। কাপড়, সাবান, তেল এনে দিত ওরা। সব সময় পরিবারের সবার প্রতি ভালমন্দ খেয়াল রাখতেন ওদের বাবা। এখন তো আর ওরা নেই। তাই আর কেউ কিছু বলবে না। কিছুই আনবে না।
ঘটনার ভয়াবহ মুহর্তের বর্ণনা দিয়ে হোসনে আরা বলেন, ১ জুন মঙ্গলবার। তখন সকাল প্রায় সাড়ে ৮টা কী ৯টার দিকে হবে। প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। গরুগুলো দেখতে যাই গোয়ালে। হঠাৎ বিকট আওয়াজ শুনতে পাই। সম্ভবত প্রচন্ড বজ্রপাত। শরীরটা প্রায় অবশ হয়ে যাচ্ছিল। গায়ে পেছনে পোড়ার জ্বালা অনুভূত লাগছে। পিঠে হাত দিয়ে মনে হয়েছে শরীরের ওই অংশে আগুনে পুড়েছে।
এ সময় উপস্থিত তার ভাই নুর হোসেন ও নুরুল ইসলাম সেটি সম্ভবত বজ্রপাতের আর্কষণ বলে উল্লেখ করে হোসনে আরার পিঠের ওই অংশে কাপড় উল্টিয়ে দেখান। সেখানে বড় পোড়ার ক্ষতচিহ্ন।
হোসনে আরা বলেন, বিকট আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গেই প্রচন্ডভাবে কম্পন হয়। তখন প্রচন্ড বেগে পাশের পাহাড় থেকে মাটি ধসে পড়ছিল আমাদের বাড়িঘরে। সঙ্গে উপড়ে পড়ছিল গাছপালা। চোখের সামনেই তান্ডবে মাটিতে বিলীন হয়ে যায় আমাদের বাড়িঘর। আমিও মাটির চাপায় পড়ি। এক সময় জ্ঞান হারাই। আর কিছুই মনে করতে পারিনি। তবে জানা ছিল ঘরের ভেতর ওরা ছিল।
হোসনে আরা বলেন, তার শ্বশুড় জাবের আলীর বাড়ি রাজশাহীর নাটোরের নগর রসুনগিরি পাড়ায়। তারা আমার স্বামী, সন্তানদের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন কিনা জানি না।
হোসনে আরার ভাই নুর হোসেন ও নুরুল ইসলাম বলেন, ওইদিন বেলা প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বোনকে উদ্ধার করে আমাদের বাড়িতে পাঠান। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাই। এরপর তাৎক্ষণিক তাদের বাড়ির ঘটনাস্থল গিয়ে দেখি, একবারে বিধ্বস্ত সব। ঘরবাড়ির কোনো চিহ্ন নেই।
তাদের (হোসনে আরা) বাড়িসহ আশেপাশের চারটি বাড়িঘর পাহাড় ধসের মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার দিন দুলা ভাই আবদুল জলিল, ভাগ্নে ইশতিয়াক আহমেদ টিপু ও ভাগ্নি নুরুন্নাহারের লাশ উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। পরদিন বুধবার ভাগ্নে আলমগীর ও তার মেয়ে আলিফার লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও আশেপাশের বাড়িঘরে চাপা পড়া আরও ৪-৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
হোসনে আরার ভাই ও অপর স্বজনরা জানান, আলমগীরের বউ কয়েক বছর আগে মারা যায়। মেয়ে আলিফার ভবিষ্যৎ ভেবে আলমগীর আর বিয়ে করেনি। আলমগীর টিঅ্যান্ডটির স্টাফ ছিল। নুরুন্নাহার রাঙামাটি সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে পড়ত। তার উপরের বড় ভাই আউয়াল হোসেন মোস্তফা নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে। ওই সময় রাঙামাটির রাজস্থলীতে কাজে থাকায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যায় সে।
এ সময় উপস্থিত আউয়াল হোসেন মোস্তফা বলেন, তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কাজের জন্য রাজস্থলী থাকায় নিরাপদে বেঁচে যান তিনি। মা ছাড়া এখন আর কেউ বেঁচে নেই। ঘরবাড়িসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বেঁচেও মরার মতো মা আর আমি।
সেই দিনের নিষ্ঠুর প্রকৃতির হানায় হোসনে আরার মতো আরও বহু মানুষ হারিয়েছেন স্বজন, প্রিয়জনকে। হারিয়েছেন বাড়িঘর সহায়সম্বল সব। কোনো কোনো পরিবারে ৪-৫ জন, ২-৩ জন আবার কোনো কোনো পরিবারের সবাইকে প্রাণ হারাতে হয়েছে পাহাড়ের মাটির চাপায়। এমন অনেক পরিবার আছে সবার মৃত্যুতে শোক, বিলাপ বা কান্না করারও নেই কেউ।
দৈনিক দেশজনতা/এন আর