২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৭:৪৬

বিখ্যাত সব চরিত্র তিন গোয়েন্দা গল্পের (পর্ব-৩)

শুধু যে গোয়েন্দাদের চরিত্র ও গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়েই পাঠকরা গোয়েন্দা গল্পের দিকে ঝুঁকে তা কিন্তু নয়। গোয়েন্দাদের তুখোড় বুদ্ধিমত্তা এবং অদম্য সাহসিকতার সঙ্গে একেকটা কেস সলভ (সৃষ্ট পরিস্থিতি সমাধান) করার গল্প পড়তে পড়তে একটা সময় পাঠক নিজেই নিজের মধ্যে ওই চরিত্রটা ধারণ করে। তখন পরবর্তী কেসের গল্প পড়ার আকাঙ্ক্ষাটা একরকম নেশার মতোই কাজ করে।

বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা কাজী আরাফাত সানিও তেমনই একজন পাঠক। পরিবর্তন ডটকম’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বই পড়ার অভ্যাসটা গড়ে উঠেছে ছোটবেলা থেকেই। যখন ফোর-ফাইভে পড়ি তখন রাক্ষস-খোক্কসের গল্প, ঈশপের গল্প, ঠাকুরমার ঝুলি পড়তাম। ক্লাস সিক্সে উঠার পরে শুরু হল কমিক্স পড়া। চাচা চৌধুরী, টিনটিন, ফ্যান্টম, আরো কত কী!

তিনি বলেন, ওই সময়ই কিভাবে যেন তিন গোয়েন্দা সিরিজের ‘গোরস্তানে আতঙ্ক’ বইটি আমার হাতে আসে। বইটা শেষ করার পর আমার মধ্যে কেমন যেন একটা নেশা ধরে যায়। তখন থেকেই গোয়েন্দা গল্প পড়া শুরু। শার্লক হোমস, ফেলুদা, বোমকেশ বক্সি, তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানার প্রায় প্রতিটি সিরিজ আমার পড়া শেষ।

আরাফাত বলেন, এসব গোয়েন্দা গল্পগুলো যখন পড়তে থাকি, তখন মনে হয় ওই চরিত্রটা আমি নিজে ধারণ করেছি এবং সাহসিকতার সঙ্গে একেকটা কেস সলভ করছি। আর এমন ধারণা সবচেয়ে বেশি হয় মাসুদ রানার সিরিজ পড়ার সময়। কারণ বইয়ে মাসুদ রানার দেখতে কেমন সে বিষয়ে লেখক তেমন কিছুই প্রকাশ করেননি। ফলে বইটি পড়ার সময় সব পাঠকই ওই চরিত্রের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেবে।

জানলাম গোয়েন্দা গল্প পড়ার সময় পাঠক কিভাবে চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যায় এবং কেন এ ধরণের গল্প পড়ার নেশা বাড়ে পাঠকের মধ্যে। এবার পরিবর্তন ডটকম’র পাঠকদের জন্য থাকছে আরো কয়েকটি বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্রের গল্প।

তিন গোয়েন্দা

তিন গোয়েন্দা সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। মূলত স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা ব্যাপক। ১৯৮৫ সাল থেকে বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে এ সিরিজ চালু হয়। প্রথম থেকেই সুলেখক রকিব হাসানই এ সিরিজ লেখার কাজ শুরু করেন। তিনি ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটানা ১৬০টি কাহিনী লেখেন। পরবর্তিতে শামসুদ্দীন নওয়াব এই সিরিজটি লেখার কাজ চালাচ্ছেন।

প্রথম আলোর এক জরিপে উঠে আসে যে, বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরদের পড়া গল্পের বইয়ের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল তিন গোয়েন্দা। জরিপে ৪৫০ জনের ৮১ জন তিন গোয়েন্দার কথা বলে যা মোট অংশগ্রহণকারীর ১৮ শতাংশ।

তিন গোয়েন্দা গল্পের প্রধান তিন চরিত্র হলো- কিশোর, মুসা, রবিন। তারা সবাই আমেরিকা থাকে। তারা তিন গোয়েন্দা নামে এক গোয়েন্দা সংস্থা চালায়। কিশোর যার প্রধান। কিশোর বাঙালি। মুসা আমান বযায়াম্বীর এবং আমেরিকান নিগ্রো। আর রবিন মিলফোর্ড আইরিশ আমেরিকান। সে বইয়ের পোকা।

গভীর চিন্তামগ্ন থাকলে কিশোর পাশা ক্রমাগত তার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে থাকে। মুসা আমানভোজন রসিক। সে বিমান চালাতেও মোটামুটি দক্ষ। রবিন মূলত চলমান জ্ঞানকোষ। তিন গোয়েন্দার কার্ডও আছে। কার্ডে বড় বড় করে লিখা ‘তিন গোয়েন্দা’। তার ঠিক নিচেই থাকে তিনটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তার নিচে নিজেদের নাম। তবে পরবর্তিতে কিশোর প্রশ্নবোধক চিহ্নের বদলে আশ্চর্যচিহ্ন ব্যবহার শুরু করে। তিন গোয়েন্দার একটা বিখ্যাত কৌশল হল ভূত-থেকে-ভূতে।

তবে তিন গোয়েন্দা কিন্তু কম সমালোচিত নয়। প্রথমত এর কাহিনীগুলো মৌলিক নয়। কিন্তু এর ব্যাপক চাহিদার কাছে এই সমালোচনা আসলে ধোপে টেকেনি। এ সিরিজের তিনশ’রও বেশি বই আছে।

কাকাবাবু

বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অনবদ্য কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র হল কাকবাবু। কাকাবাবুর আসল নাম রাজা রায়চৌধুরী। কাকাবাবু মধ্য বয়সী এক গোয়েন্দা। তিনি ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা।

কাকাবাবু একবার আফগানিস্তানে গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তারপর থেকেই কাকাবাবুর এক পা ভাঙ্গা। হাঁটেন ক্র্যাচে ভর দিয়ে, অতি কৌশলে। তিনি কিছুদিন সিবিআই’র উপদেষ্টাও ছিলেন। তিনি কখনো বিয়ে করেননি।

কাকাবাবু অসম্ভব সাহসী। তিনি তার ভাইপো সন্তু আর সন্তুর বন্ধু চাপাবাজ জোজোকে নিয়ে অনেক রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার করেছেন। কাকাবাবু শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও তার বুদ্ধির জোরে তিনি বিভিন্ন জটিল জটিল সব সমস্যার সমাধান করে বেড়ান। কাকাবাবু প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে আনন্দমেলা পত্রিকায়। গল্পের নাম ছিল ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মোট ৩৬টি কাকাবাবুর কাহিনী লিখেছেন।

হাতকাটা রবিন

হাতকাটা রবিন একটি কিশোর উপন্যাস। মুহম্মদ জাফর ইকবালের এই উপন্যাস-নির্ভর ধারাবাহিকও প্রচারিত হয়। একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত সেই ধারাবাহিকের নাম ছিল ‘হাকারবিন’। গল্পের অন্যতম চরিত্র টোপন, যার বর্ণনায় ধারাবাহিকতায় সম্পূর্ণ গল্পটি এগিয়ে চলে। টোপনের মাধ্যমেই জানা যায় ওদের পাড়াতে থাকতে আসে ওদেরই বয়সী একটি ছেলে রবিন। সব বন্ধুরা অবাক হয়ে রবিনকে দেখতে থাকে। কারণ রবিনের বাম হাত কনুইয়ের কাছ থেকে কাটা। রবিনের সঙ্গে ওদের বন্ধুত্ত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগে না।

ফুটবল খেলা, প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি সবকিছুই যেনো কিশোর বয়সের দূরন্তপনার সাক্ষী। কিছুদিনের মধ্যেই রবিন হয়ে ওঠে এই ক্ষুদে গোয়েন্দা গ্রুপের অন্যতম সদস্য। রবিন যেনো সবকিছুতেই একটু বেশি জেদি। যেমন- ফুটবলের মালিক রবিন দেখে রবিনই হয়ে যায় ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন। যদিও টিমের সবচাইতে ভালো খেলোয়াড় সলিল, ওদের-ই আরেক বন্ধু।

দুঃসাহসী টিন‌টিন

বেলজীয় শিল্পী জর্জ রেমি (১৯০৭–১৯৮৩) রচিত একটি কমিক স্ট্রিপ সিরিজ। রেমি এর্জে (বাংলায় হার্জ নামে পরিচিত) ছদ্মনামে এই কমিক সিরিজটি রচনা করেন। ১৯২৯ সালের ১০ জানুয়ারি ল্য ভাঁতিয়েম সিয়েক্‌ল (Le Vingtième Siècle) নামক একটি বেলজিয়ান সংবাদপত্রের ল্য প্যতি ভাঁতিয়েম (Le Petit Vingtième) নামক শিশুদের ক্রোড়পত্রে ফরাসি ভাষায় সর্বপ্রথম এই সিরিজের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

ধারাবাহিকভাবে মোট চব্বিশটি অ্যালবামে প্রকাশিত এই সিরিজটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। টিনটিনকে নিয়ে একটি সফল পত্রিকা প্রকাশিত হয়। টিনটিনের গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র ও নাটকও নির্মিত হয়। সিরিজটি বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ইউরোপীয় কমিকসগুলির অন্যতম। মোট ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত এই সিরিজের বইয়ের কপি বিক্রির সংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :জুন ২৭, ২০১৭ ১১:০২ পূর্বাহ্ণ