মেয়েটি অনেক্ষণ যাবৎ আমাকে দেখছিল। আমি লক্ষ্য করলাম তার দিকে। স্কুলের বারান্দার পিলার ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্বিতীয় বার তাকালাম। বাদামি চোখে বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মেঘনার চরের এই অজপাড়া গাঁয়ে মেয়েটি অনেক সুন্দর চোখ নিয়ে জন্মেছে। বয়স ৮/৯ বছর হবে হয়তো। পরনে রং-জ্বলা ফ্রক। পেটের দিকটা ছেঁড়া।
লাইনে দাঁড়ানোর জন্য সকালের দিকের হুড়োহুড়ি কিছুটা কমেছে। পোশাক আর কেমন বাকি আছে দেয়ার জন্য। তানভির বললো- প্রায়শেষ পর্যায়ে। চর ঈশান-বালায় আমাদের কোম্পানি ঈদের পোশাক দিচ্ছে। শুধু মাত্র স্কুলের প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য। এটা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেয়ার জন্য। আলাপ হলো স্কুলের পরিচালকের সাথে। তার নাম হুমায়ুন। তিনি বসে আছেন আমার পাশে। তবে বসায় অস্বস্তি। মেরুদণ্ড সোজা করে অদ্ভুতভাবে বসে ছিলেন এতোক্ষণ। আমি বলাতে এখন ঠিক করে বসেছেন।
আমরা সকাল সকালই ঈদের উপহার নিয়ে চলে এসেছিলাম স্কুলের মাঠে। পরিচালক হুমায়ুন সাহেব দৌড়ে এসে এক রকম হুমড়ি খেয়ে পড়লেন স্কুলের মাঠে। তাঁর কান্না-কাটি দেখে প্রথমে থমকে গিয়েছিলাম। তিনি আসলে অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। এই স্কুল তিনি ৫ বছর ধরে চালাচ্ছেন। প্রায় প্রতি বছরই ঝড়ে স্কুল ভেঙ্গে যায়। সেটা মেরামতের জন্য ১ মাস স্কুল বন্ধ থাকে। গ্রামের সবাই দৌড়ে এসে সহযোগিতা করে। স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই বলে ঐ টুকু পর্যন্ত গিয়েই পড়ালেখা শেষ হয়ে যায়। নিজের হাতে গড়া এই স্কুল নিয়ে অনেক স্বপ্ন হুমায়ুন সাহেবের। সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঘনার বুকে ভেসে থাকা এই চরের শিশুরা একদিন পৃথিবীর আলোর মিছিলে শামিল হবে। কিন্তু তারা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে আর এগুতে পারে না।
গত ৫ বছরে তার স্কুলে এমন সহযোগিতা নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। তাই আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে আবেগে কেঁদে ফেলেছেন। তার গায়ে জীর্ণ-কুচকানো চেক শার্ট। সাইজ ছোটর কারণে হাতা উপরের দিকে ওঠে আছে। তার প্যান্ট পরা দেখেই বোঝা যায় সেটা পরতে অনভ্যস্ত তিনি। নিজে কৃষি করেন। আর বাকি সময় স্কুলের কাজে ব্যয় করেন। স্কুল পরিচালনায় তার সাথে আছেন আরো ৭জন। তারাই স্কুলের শিক্ষক। তাদের পড়াশুনো খুব বেশি নয়। প্রথম প্রথম ক্লাস নিতে সমস্যা হতো। নিজেদের অনেক পড়াশোনা করতেহতো। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাশ নেন মহিলারা। গ্রাম থেকে মেধাবী মহিলাদের বেঁছে নেয়া হয়। পরে স্কুলের সিনিয়র শিক্ষকরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেশিক্ষিকা হিসেবে। স্কুলের শিক্ষকদের কেউ বেতন পান না। তবে তাদের সংসার চলার জন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা এগিয়ে আসেন। তারা ধান, চাল, গম, ক্ষেতের লাউ, কুমড়া, সিম, করল্লা, নদীতে ধরা মাছ ইত্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করেন।
স্কুল নিয়ে অনেক কথা হলো তার সাথে। একটা আলোর বাতিঘর তৈরি করতে তাদের সংকল্প আর পরিশ্রম দেখে আমার মাথা নত হয়ে এলো। উল্টো আমার চোখেই পানি চলে এলো। আমি হুমায়ুন সাহেবকে জড়িয়ে ধরে জোরে চেপে রাখলাম। এটা আশ্বাসের চাপ। তিনি বুঝলেন সেটা।
এখন তিনি ভাবছেন সত্যিই তিনি অনেক একটা বড় কাজ করছেন। আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছি। তার স্কুলের খবর মিডিয়াতে আসবে। চাঁদপুরে প্রদীপের আলোর নিচের অন্ধকারে থাকা এই স্কুল সত্যই একদিন নিজের আলোয় অলোকিত হবে। আমি লক্ষ্য করলাম হুমায়ুন সাহেবের চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে।
ঈদের উপহার দেয়া প্রায় শেষ হয়ে গেল এক রকম। বিশেষ কেউ নেই আর নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। আমি স্কুলের বারান্দায় তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় ডাক দিলাম। কিন্তু সাড়া দিলো না। আমি হুমায়ুন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটি সম্বন্ধে। হুমায়ুন সাহেব বললেন, স্যার, এটা আমার মেয়ে রানি। আমি হেসে বললাম, সম্রাট হুমায়ুনের মেয়ে রানি! এবার আমার সাথে যোগ হয়ে হুমায়ুন সাহেবও মেয়েকে ডাকলেন। কিন্তু মেয়ে সাড়া দিচ্ছে না। হুমায়ুন সাহেব চেয়ার থেকে ওঠে গেলেন। হাত ধরে মেয়েকে নিয়ে আসলেন আমার কাছে। আমার হাতল চেয়ারের হাতল ঘেঁষে দাঁড়ালো রানি। মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। তার হাতে পোশাক নেয়ার টোকেন। আমি টোকেন নিয়ে নিলাম। ওর বয়সের সাথে সাইজ মিলিয়ে এক সেট জামা নিয়ে রানির হাতে দিলাম। রানি কিছুতেই নেবে না সেটা।
হুমায়ুন সাহেব বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন মেয়েকে। রানি কান্না শুরু করলো। আমি থামাতে চেষ্টা করলাম। রানি কান্না থামালো। বললাম, আমার দিকে তাকাও। রানি তাকালো। ওর সুন্দর চোখ ভিজে আরো করুণ হয়ে আছে দৃষ্টি। মুখের সামনে চলে আসা চুলগুলো সরালো রানি। বললাম, তুমি বলো আমাকে। কী হয়েছে তোমার? রানি কিছু বললো না। আমি হুমায়ুন সাহেবকে বললাম, মেয়ের সাথে কথা বলতে। তিনি মেয়েকে ডেকে নিয়ে একাকী কথা বললেন কিছুক্ষণ। তারপর হেসে উঠলেন। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলাম। হুমায়ুন সাহেব বললেন, স্যার, আমার একটা ছোট ছেলে আছে। রানি খুব আদরের ভাই। তাই সে একা ঈদের নতুন পোশাক পরবে না। ভাইয়ের জন্যও পোশাক লাগবে। তাই নিজেরটা নিচ্ছে না। আমার মেয়ে জানে, এক টোকেনে ২টি ঈদের জামা নেয়া যাবে না। তাই দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। লাইন ধরেনি। আমিও হেসে ওঠলাম। অবাক হলাম, রানির সুন্দর চিন্তা আর ছোট ভাইয়ের প্রতি মমতা দেখে। জিজ্ঞেস করলাম, ছেলের বয়স কতো। হুমায়ুন সাহেব বললেন- এই বছরই ৫ বছর পূর্ণ হবে। স্কুলে আসা শুরু হবে এই বছরই। আমি ক্লাসওয়ানের শিশুদের জন্য আনা ঈদের কাপড় থেকে একটা প্যাকেট বের করলাম। রানির ও তার ছোট ভাইয়ের কাপড় তার হাতে দিলাম। রানি চোখে-মুখে একটা খুশির ঝিলিক খেলে গেলো। চুল দুলিয়ে, লম্বা পায়ে দৌড়ে দৌড়ে স্কুলের মাঠ পেরিয়ে চলে গেলো। আমি তাকিয়ে রইলাম সেই পথে। ঈদের আনন্দটা সত্যিই ভাগ করে নেয়ার জন্য। রানি তার ভাইয়ের সাথে ঈদের আনন্দটাকে ভাগ করেই নিলো।