২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:৩৪

রাঙামাটিতে নানান সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস

শাহ আলম,রাঙামাটি প্রতিনিধি:
লংগদুতে পাহাড়িদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা এবং পাহাড় ধসের বিপর্যয় রাঙামাটিতে সবক্ষেত্রে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। খাদ্য, অর্থনীতি, যোগাযোগ, পরিবহন, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে নানান সংকট। এসব সংকটে এখানকার মানুষ। লাগাতার মোকাবেলার পরও কাটছে না সহসা। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমেছে মারাত্মক ধস। পরিবহন ব্যয় বেড়ে হয়েছে দেড়-দুইগুন।
এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ওঠে আসে রাঙামাটির সংকটময় পরিস্থিতির চালচিত্র। তারা জানান, সাম্প্রতিক দুর্যোগের পর তৈরি হচ্ছে একের পর সংকট। সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়ায় ধস নামছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। তা ছাড়া যাতায়াত ও পরিবহন বন্ধ হওয়ায় তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। অর্থনৈতিক আর পরিবহন সংকটের কারণে এখন দেখা দিচ্ছে খাদ্য সংকটও।
প্রশাসনের পক্ষে জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান বলছেন, দুর্যোগের পাশাপাশি সংকট মোকাবেলায় তৎপর প্রশাসন। এর মধ্যে প্রায় সংকট দূর করা সম্ভব হয়েছে। দুর্গতদের সহায়তায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে। ফলে পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে চলেছে।
কিন্তু ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষসহ দুর্গত লোকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা বলছেন, রাঙামাটির পরিস্থিতি এখনও সবক্ষেত্রে সংকটময়। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাজ করছে স্থবিরতা। এতে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি স্থায়ীভাবে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত সংকট কাটবে না। কবে নাগাদ ঠিক হবে তাও অনিশ্চয়তায়। এ অবস্থায় সহসা সংকট উত্তরণের আশা একদম ক্ষীণ। বিদ্যুৎ সংকটও পুরোপুরি কেটে যায়নি। ভারি বৃষ্টিতে পানি ময়লা ও ঘোলাটে হওয়ায় তৈরি হয়েছে খাবার পানির সংকট।
দুর্যোগের টানা আট দিন পর সাময়িকভাবে রাস্তা মেরামতের ফলে ২১ জুন রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে হালকা যান চলাচল শুরু হলেও ভারী যান চলাচলে সচল হয়নি সড়কটি। ফলে সরাসরি পর্যাপ্ত মালামাল পরিবহন করা যাচ্ছে না। সরাসরি বাস সার্ভিস চালু না থাকায় রাঙামাটি থেকে লোকজনকে যাতায়াত করতে হচ্ছে ভেঙে ভেঙে। ফলে  ভোগান্তি কাটেনি যাতায়াতকারী লোকজনের। সড়কের সাপছড়ির শালবনে বিধ্বস্ত অংশে মেরামত করা রাস্তা দিয়ে ১ টনের অধিক মালামাল পার করা যাচ্ছে না। একাধিকবার ভেঙে ভেঙে ওঠানামা করে গাড়ি পাল্টিয়ে মালামাল আনা-নেয়া করতে হচ্ছে।
এদিকে ব্যবসায়ী, জোত মালিক, কাঠুরিয়া, শ্রমিক, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকসহ রাঙামাটির বিশাল একটি জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল কাঠের ওপর। কিন্তু রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে ভারী যান চলাচল করতে না পারায় কাঠ ব্যবসা ও পরিবহন এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। ফলে আয়-উপার্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে বসেছেন অসংখ্য মানুষ। লোকসান যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে আম ,কাঁঠাল, কলা, আনারসসহ কোটি কোটি টাকার কাঁচা পণ্য। এতে অপূরণীয় লোকসানের ক্ষতির শিকার অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত  অসংখ্য মানুষ। পর্যটক আসা-যাওয়া করতে না পারায় পর্যটননির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাজ করছে স্থবিরতা। এ কারণেও বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন বলে জানান, রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমাসহ পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলেন, আগে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বাইরে থেকে আমদানিক করা মালামাল রাঙামাটি শহরের মূল বাণিজ্যিক এলাকা পর্যন্ত পরিবহন করতে যে টাকা ব্যয় হতো, এখন ভেঙে ভেঙে আনা-নেয়া করতে হওয়ায় পরিবহন ব্যয় বেড়ে দেড়-দুইগুন হয়েছে। মূল শহরে পৌঁছাতে যে পরিমাণ পরিবহন ভাড়া দিতে হতো সেই একই ব্যয়ে মালামাল নেয়া যাচ্ছে সাপছড়ির শালবন পর্যন্ত। বড় গাড়িতে শালবন পর্যন্ত মালামাল আবার সেখান থেকে ছোট গাড়িতে করে মূল শহরে পরিবহন করে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এতে শ্রমিক খরচসহ বরাবর দেড়-দুইগুন অধিক ব্যয় হচ্ছে মালামাল পরিবহনে। তা ছাড়া পর্যাপ্ত মালামাল পরিবহন করা যাচ্ছে না। ফলে অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে খাদ্যসহ পণ্য সংকট। পরিবহন সংকটের কারণে শহরে পর্যাপ্ত মালামাল মজুত করা সম্ভব হচ্ছে না।
শুক্রবার রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের শালবন গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম থেকে বড় গাড়িতে করে জ্বালানি তেল নিয়ে আবার সেখান থেকে ছোট গাড়িতে করে পারাপার করানো হচ্ছে। কক্সবাজার থেকে বড় ট্রাকে কয়েকজন মিলে ১৫ হাজার টাকা ভাড়ায় ১০ টন নাপ্পি (শুকটকির লাসাগুড়া, যা পাহাড়িদের বিশেষ ভোগ্যপণ্য) পরিবহন করে এনেছেন বরে জানান, নাপ্পি ব্যবসায়ী আপ্রু মং রাখাইন। তিনি বলেন, শালবন থেকে আবার ছোট চারটি গাড়িতে করে নাপ্পিগুলো নিতে হচ্ছে রাঙামাটি শহরে। এতে শ্রমিক খরচ ও গাড়িভাড়া মিলে অতিরক্ত পরিবহন খরচ হচ্ছে ১০ হাজার টাকা।
এদিকে রাঙামাটি পৌরসভার ভেদভেদীতে স্থাপিত টোল আদায় কেন্দ্রে পরিবহন ও পণ্যের ওপর উপর্যুপরি টোল আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন, ব্যবসায়ী ও পরিবহণ চালকরা। তবে বিষয়টির ব্যাপারে জানতে চাইলে ইজারাদার মো. আবু তৈয়ব বলেন, মোটা অংকের পূঁজি বিনিয়োগে ইজারা নিতে হয়েছে। সম্প্রতি দীর্ঘদিন ব্যবসা বন্ধ ছিল। এতে অনেক লোকসান গেছে। নির্ধারিত হারে টোল আদায় করছি। ত্রাণের গাড়ি এমনি ছাড়ছি।
সাপছড়ির শালবনের মেরামত করা রাস্তা দিয়ে ১ টনের অধিক মালামাল পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। কিন্তু টাকার বিনিময়ে অধিক পরিমাণ বোঝাই গাড়ি পার হতে দেয়া হচ্ছে বলে দায়িত্বে থাকা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে জানান, রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিরোধে সড়ক ও জনপথ বিভাগের লোকজন দিয়ে পাহারা বসানো হবে। কারণ এমন কিছু করা হলে রাস্তার ক্ষতি হয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
তা ছাড়া রাত ৮টার পর ভোর ৪টা পর্যন্ত মালবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও ওই সময়ে মানিকছড়িতে যাত্রীবাহী ও জরুরি গাড়ি পুলিশ আটকাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন চালক অনেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চালকরা জানান, বৃহস্পতিবার সেখানে পুলিশ রাত ৮টা হতে ১০টা পর্যন্ত গাড়ি আটকানোর কারণে যাতায়াতকারীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। ওই সময় জরুরি বিদ্যুৎ কর্মীদের গাড়িও আটকে দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মানিকছড়ি পুলিশ চেকপোস্টে থাকা পুলিশের এসআই মো. ইউসুফ বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, যানজট নিরসনে কিছু গাড়ি আটকে রাখতে হয়েছে। এতে জরুরি বিদ্যুতের গাড়িও আটকা পড়ে।
বনরূপা কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. সোলাইমান চৌধুরী বলেন, সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়ায় কাঠ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে শ’শ’ ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কাঠুরিয়া ও জোত মালিক বেকার হয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন। সংকট মোকাবেলায় দ্রুত সড়ক মেরামত দরকার।
বনরূপা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক তাপস দাশ বলেন, ব্যবসায়ীরা এখন চরম ভোন্তিতে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে অনেকগুন। ৫০ টাকার খরচের কাটনে এখন পরিবহন করতে হচ্ছে ২৫০ টাকায়। ব্যবসা-বানিজ্যে মারাত্মক ধস নামছে। এতে অর্থনৈতিক, খাদ্য, পণ্যসহ নানান সংকট দেখা দিচ্ছে। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ভারী যান চলাচল উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত সংকট কাটবে না।

দৈনিক দেশজনতা /এমএম

প্রকাশ :জুন ২৫, ২০১৭ ১১:২১ পূর্বাহ্ণ