চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। দশ শিক্ষাবোর্ডে পাশের হার ৮০ দশমিক ৩৫। গত বারের তুলনায় আট শতাংশ কম। গত বছর পাশের হার ছিল ৮৮ দশমিক ২৯। একই সঙ্গে গত বছরের তুলনায় কমেছে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী এর সংখ্যা। এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ চার হাজার ৭৬১ জন পরীক্ষার্থী। এবার দশ বোর্ডে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৯৬২ শিক্ষার্থী। পাশ করেছে ১৪ লাখ ৩১ হাজার ৭২২ জন।
গত বারের তুলনায় এবার ৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী কম উত্তীর্ণ হওয়া এবং জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা ও বিশ্লেষণ হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ ফল প্রকাশের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘অতীতে পাবলিক পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নের পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এ বছর নতুন পদ্ধতিতে নম্বর দেয়ার কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় তুলনামূলকভাবে অন্যান্য বছরের চেয়ে কম পাস করেছে।’ প্রধানমন্ত্রী ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন-‘শিক্ষার মনে উন্নত করতে পরীক্ষার খাতা দেখার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা সময়োপযোগী’।
অন্যদিকে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সচেতন ব্যক্তিরা এ ফলাফলকে ভিন্নভাবে দেখছেন। তারা এটিকে ফল বিপর্যয় বলেও অভিহিত করেছেন। বলেছেন-খাতা মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি, নৈর্ব্যক্তিক নম্বর ৩০ এ নামিয়ে আনা ইত্যাদি কারণে এবার ফল বিপর্যয় ঘটেছে। তবে তারা এটাকে ফল বিপর্যয় বললেও অনেকেই তা মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য-প্রতিবছর একই হারে কিংবা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অধিক হারে পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হবে এমন কোনো কথা নেই। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং পরীক্ষায় খাতায় তাদের দেয়া উত্তর থেকেই পাশের হার বেরিয়ে আসে। কোনো পরীক্ষার্থী ভালো পরীক্ষা দিলে তাকে যেমন অকৃতকার্য করানো অসম্ভব, তেমনি অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ করানোও সম্ভব নয়। মনে রাখা দরকার, পরীক্ষায় পাশের হার শিক্ষা বোর্ড বা সরকার নির্ধারণ করে দেয় না। উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের সংখ্যার ভিত্তিতেই পাশের হার নির্ধারিত হয়। তবে, পরীক্ষা বা খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন বা নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে উত্তীর্ণ অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে বাড়তে পারে। বলা বাহুল্য, এবার নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন হয়েছে বিধায় ফলাফলে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না।
এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলেই আমাদের দেশে শিক্ষার মান নিয়ে নানা কথাবার্তা হয়। তবে, এসএসসির ফলাফল শিক্ষার মান নির্দেশ করে কীনা সেটা একটা প্রশ্ন। কারণ শিক্ষা একটি অতি বড় ক্যানভাস। এর একটি ক্ষুদ্রাংশে পুরো চিত্র-ফুটে ওঠে সম্ভব নয়। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবন শেষ করার পরই বোঝা যায় তার শিক্ষার মান কী রকম। তবে এটা ঠিক যে, একজন শিক্ষার্থীর জীবনে প্রথম সনদ অর্জনের পরীক্ষা এসএসসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পরীক্ষায় অর্জিত ফলাফল তার পরবর্তী শিক্ষা জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে এসএসসিতে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের ভিত্তি স্থাপন এবং মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক বলে শিক্ষাসচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন।
শিক্ষার মান বাড়ানোর তাগিদ শোনা যায় প্রায়ই। এর আবশ্যকতা নিয়েও প্রশ্ন নেই। পাশের হার কম-বেশি হলে উচ্ছ্বাস বা হা-হুতাস না করে দায়িত্বশীলদের উচিত শিক্ষার মান বাড়ানোর সঠিক পদ্ধতি উদ্ভাবন ও তা প্রয়োগে মনোনিবেশ করা। শিক্ষা খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বিশিষ্টজনেরা সব সময় বলে থাকেন। একই সঙ্গে সবার জন্য সমান সুবিধাও নিশ্চিত করা দরকার। স্বচ্ছল পরিবারের একজন শিক্ষার্থী নানা রকম সুবিধা পেয়ে ফলাফল ভালো করে। কিন্তু অধিকতর মেধাবী হওয়া সত্বেও দরিদ্র পরিবারের একজন শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় তত্ত্বাবধানের অভাবে কাংখিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধার এ বৈষম্য দূর করতে পারলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, তার সুদূর প্রসারিত সুফল একদিন ভোগ পাওয়া যাবে।