নিজস্ব প্রতিবেদক:
একসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে (জবি) র্যাগমুক্ত ঘোষণা করা হলেও সেটি আর ধরে রাখতে পারেনি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা। নতুন করে শুরু হয়েছে এই উৎপাত। নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগ দিতে মেতে উঠেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। তারা দাবি করছে, এর মধ্য দিয়ে নবীনদের ম্যানার (আচরণ) শেখাচ্ছেন তারা। আর তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সদ্য ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীরা। নবীনদের র্যাগ দেয়াকে কেন্দ্র করে এমনকি ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মাঝে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১ থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সদ্য ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীদের যেখানেই পাচ্ছে সেখানেই র্যাগ দিচ্ছে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে র্যাগ দিচ্ছে, আবার কেউ কেউ দল বেঁধে র্যাগ দিচ্ছে নবীনদের। মেয়ে শিক্ষার্থীরাও বাদ যাচ্ছেন না। ছেলেদের সমানতালে তাদেরও র্যাগ দিচ্ছেন ‘বড় আপু’রা। ক্যাম্পাসের পাশাপাশি র্যাগ চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিবহনের বাসগুলোতেও। প্রতিদিন নবীন শিক্ষার্থীদের দিয়ে বাসের সবাইকে সালাম দেওয়াচ্ছে। আবার কাউকে দিয়ে গান গাওয়াচ্ছে সবার সামনে নিয়ে। বাসের আসন থেকে তুলে কাউকে আবার দাঁড় করিয়ে রাখছে।
গত ১ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণে উচ্ছ্বসিত নবীন শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই প্রথম দিনই উপস্থিত হয় ক্লাসে। সেদিন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পদচারণে মুখরিত ছিল। প্রাণোচ্ছল হাসিমাখা মুখগুলো ঘুরে বেড়িয়েছে ক্যাম্পাস জুড়ে। কিন্তু দুই দিন যেতে না যেতেই নবীন শিক্ষার্থীদের সেই হাসিমাখা মুখ আর দেখা যাচ্ছে না। নবীন শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালেই মনে হয় তারা অসহায় বোধ করছে। তাদের ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে, কখন কোন বড় ভাইয়ের হাতে র্যাগিং হয়। তবে র্যাগিং দেয়া বড় ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নবীন শিক্ষার্থী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা নবীন কয়েকজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অবস্থিত একটি বাসের মধ্যে বসে ছিলাম। হঠাৎ করে তিন বড় ভাই (নাম উহ্য রাখা হলো) আমাদের কাছে এসে বসেন। প্রথমে আমাদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর বিভিন্নভাবে র্যাগ দেয়া শুরু করে। কাউকে বলছে গান গাইতে। আবার কাউকে বলছে প্রপোজ করতে, কাউকে বলছে নাচতে। এখন মনে হচ্ছে কয়েক দিন পরে ক্লাসে এলেই ভালো হতো। অন্তত তত দিনে এই র্যাগ পর্ব শেষ হতো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যের সামনে প্রায় ৪৫ মিনিট ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ১২তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী (নাম উহ্য রাখা হলো) নবীন শিক্ষার্থীদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কয়েকজন সাংবাদিক সেখানে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নবীন শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন তিনি। কী করছিলেন- সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চাইলে ১২তম ব্যাচের ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘নবীন শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচয় হচ্ছিলাম। আর তাদের ম্যানার শিখাচ্ছিলাম।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে ম্যানার শেখানোর দায়িত্ব দিয়েছে কি না জানতে চাইলে কোনো কথা না বলে সেখান থেকে চলে যান তিনি।
ফার্মেসি বিভাগের সিনিয়র এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখা যায় নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে দরজা বন্ধ করে র্যাগ দেয়া হচ্ছে। নবীন শিক্ষার্থীদের দিয়ে গাওয়াচ্ছে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পি মমতাজের ‘ফাইট্টা যায়’ গানটি। জানা গেছে টানা তিন দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নবীনদের এভাবে র্যাগ দেয়া হয়। যে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা র্যাগ দিচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বললে তিনি দাবি করেন, ‘আমরা কোনো র্যাগ দিচ্ছি না, তাদের সাথে পরিচিত হচ্ছি।’ পরিচয় হতে তিন দিন লাগে? তার ভাষ্য, ‘আসলে একেক সময় একেকজনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। তাই একটু বেশি সময় লাগছে।’ এ ব্যাপারে ফার্মেসি বিভাগের একজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু আমি শুনিনি। এমন কিছু যদি হয়ে থাকে সেটা ঠিক হয়নি। আমরা বিষয়টি দেখছি।’
এই র্যাগ দেয়াকে কেন্দ্র করে আবার ক্যাম্পাসে তুলকালাম ঘটে গেছে। গত ৩ জানুয়ারি নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেয়া ও আধিপত্য বিস্তারকে নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে সোহান ও স্বপন নামের দুই শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় পাঁচ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ বেশ কিছু দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে সেদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সিনিয়র শিক্ষার্থীই এই র্যাগ ‘উৎসবে’ শামিল হয়েছে তা নয়। অনেক শিক্ষার্থী ছিলেন এর বাইরে। তারা জানান, র্যাগ দেয়ার একটা মাত্রা থাকা উচিত। মাত্রা অতিক্রম করে র্যাগ দেয়ার কোনো মানে হয় না। বর্তমানে জগন্নাথে যেভাবে র্যাগ দেয়া হচ্ছে তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়িয়ে যাবে। আর তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম-সুখ্যাতি নষ্ট হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি