স্বাস্থ্য ডেস্ক:
থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia) একটি বংশগত রক্তের রোগ। হিমোগ্লোবিন রক্তের খুবই গুরত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা নিশ্বাসের সঙ্গে যে অক্সিজেন বহন করি, হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো তা শরীরের সমস্ত অংশে বহন করে নিয়ে যাওয়া। এ রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী এই হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় দুটি আলফা প্রোটিন ও দুটি বিটা প্রোটিন দিয়ে। যদি এই প্রোটিনগুলোর উৎপাদন শরীরে কমে যায়, তবে শরীরের হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনও কমে যায় এবং থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। আলফা ও বিটা প্রোটিন তৈরি হয় জীন হতে। দুই গ্রুপের হিমোগ্লোবিন চেইনের সংশ্লেষণ মূলত জেনেটিক্যালি নিয়ন্ত্রিত হয়।
কেউ যখন কোনো ত্রুটিপূর্ণ জীন তার বাবা-মায়ের কাছ হতে বংশানুক্রমে পায়, তখনই মূলত থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। সুতরাং থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। এর ফলে রক্তশূন্যতাও দেখা দিতে পারে। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতাবা অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততাথেকে শুরু করে অঙ্গহানি পর্যন্তঘটতে পারে।
থ্যালাসেমিয়ার রকমফের থ্যালাসেমিয়া দুটি প্রধান ধরনের হতে পারে
আলফা থ্যালাসেমিয়া (Alpha-thalassemia)
বিটা থ্যালাসেমিয়া (Beta-thalassemia)
আলফা থ্যালাসেমিয়া (Alpha-thalassemia): চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া ধারা (Chain) গঠিত হয়। আমরা বাবা-মা প্রত্যেকের কাছ থেকে দুটি করে এই জিন পাই। এই জিনগুলোর মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে Alpha-thalassemia হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে তত বেশি মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে।
সাধারনত একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোনো লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াবে। দুইটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থাকে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Alpha-thalassemia minor) অথবা, আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট ( Alpha-thalassemia trait) অথবা, কুলিস এ্যানিমিয়া (Cooley’s anemia)। তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে এর উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থাকে বলে হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ। চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (Alpha thalassemia major) অথবা হাইড্রপস ফিটেইলস (Hydrops fetalis)।
এর ফলে প্রসবের (delivery) পূর্বে অথবা জিনের পরপর ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়। নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়।
বিটা থ্যালাসেমিয়া (Beta-thalassemia): Beta-thalassemia ধারা (Chain) গঠিত হয় দুইটি জিন দিয়ে। বাবা-মা প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে মোট দুইটি জিন আমরা পেয়ে থাকি। একটি অথবা উভয় জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে Beta-thalassemia দেখা দেয়। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়া বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়।
অন্যদিকে বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তবে বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ ও উপসর্গ
থ্যালাসেমিয়া হলে সাধারণত যেসব লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলেঃ-
অবসাদ অনুভব,
দুর্বলতা,
শ্বাসকষ্ট,
মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া,
অস্বস্তি,
ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস),
মুখের হাড়ের বিকৃতি,
ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি,
পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া,
গাঢ় রঙের প্রস্রাব।
রোগ নির্ণয়ঃ
শরীরে যদি কারো অ্যানিমিয়া বা রক্তে হিমোগ্লোবিন পরিমাণ কম থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে এটা থ্যালাসেমিয়া কিনা, যদি থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে তবে স্বল্প নাকি মেজর সেটাও নিশ্চিত হতে হবে। এরউপর ভিত্তি করেই চিকিৎসকরা এর চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বাহক শনাক্তকরণের জন্য যে রক্ত পরীক্ষা সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য, তাকে বলা হয় ‘হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস’। কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই ধারণা করা সম্ভব কারো থ্যালাসেমিয়া মাইনর হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না।
তাই বিয়ের আগে পাত্র এবং পাত্রী উভয়কে থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা সেটা পরীক্ষা করাতে হবে। বিয়ের পর যদি জানা যায় যে, কারো থ্যালাসেমিয়া মাইনর রয়েছে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, এতে করে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হলে কি করণীয় তা জানা যাবে।
থ্যালাসেমিয়ার ভয়াবহতা:
আমাদের শরীরে রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল তিন মাস। লোহিত কণিকা অস্থিমজ্জায় অনবরত তৈরি হচ্ছে এবং তিন মাস শেষ হলেই প্লীহা এ লোহিত কণিকাকে রক্ত থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে যায় এবং এর ফলে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। এতে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন পরিষ্কারের কাজে নিয়োযিত থাকে প্লীহা,ফলে প্লীহার (Spleen) কার্যকারিতার উপর অতিরিক্ত চাপ পরে এবং প্লীহা আয়তনে বড় হয়ে যায় (Spleen Enlargement)। থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে দিনের পর দিন রক্ত দিয়ে যেতে হয়। সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় নয় লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। এসব শিশুর অধিকাংশই বেঁচে থাকে রক্ত পরিসঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে।
উপরন্তু পানিবাহিত রোগের মতো নানা রক্তবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়; যেমন—জন্ডিস, এইচআইভি, হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’, ভাইরাসজনিত রোগ। এছাড়া প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে জমা হচ্ছে ২০০ মিলিগ্রাম করে আয়রন। প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে ২০০ মিলিগ্রাম আয়রন জমা হলে ৫০ ব্যাগ রক্তের সঙ্গে ১০ গ্রাম আয়রন শরীরে জমা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে এই অতিরিক্ত আয়রন আস্তে আস্তে লিভার প্যানক্রিয়াসের প্রতিটি কোষ ধ্বংস করে দেয় এবং হৃৎপিন্ড,প্যানক্রিয়াস, যকৃত, অণ্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতাকেনষ্ট করে দেয়।
ফলে ডায়াবেটিস, লিভার সিরোসিস রোগের উৎপত্তি হয়। এছারাও এই রোগীকে প্রচন্ড সাবধানে চলাফেরা করতে হয় নয়ত যে কোন মুহুর্তে অন্য যেকোনো রোগের জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। থ্যালাসেমিয়ার রোগীর জীবনকাল ২০-৩০ বছর পর্যন্ত। এই স্বল্পকালীন জীবনে রোগীর নিজের ও পরিবারের যে মানসিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। থ্যালাসেমিয়ার রোগীর স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা হচ্ছে অন্যতম।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি