নিজস্ব প্রতিবেদক:
দুর্ভোগ আর ভোগান্তি সঙ্গী করেই প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফিরছে কর্মজীবী মানুষ। ছুটি শেষে কর্মজীবী মানুষ বুধবার থেকেই ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে। তবে গতকাল শনিবার দিনভর ছিল ঢাকামুখী জনস্রোত। শেষরাত থেকেই ঢাকার বাস টার্মিনাল, ট্রেন স্টেশন ও সদরঘাটে মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। যাত্রীবোঝাই ছিল দূরপাল্লার বাসগুলোয়। কোলাহলমুখর ছিল আন্তজেলা টার্মিনালগুলো। বাড়তি ভাড়া ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ২৩ জেলা থেকে ঢাকামুখী হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে শিমুলিয়া ঘাটে। সকাল থেকেই শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি ও শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি নৌপথের লঞ্চ, ট্রলার ও স্পিডবোটসহ প্রতিটি নৌযানে ছিল যাত্রীদের আগে ওঠার প্রতিযোগিতা। এ সময় পদ্মা পাড়ি দিতে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়েন ঢাকাগামী যাত্রীরা। ফলে শিমুলিয়া ও কাওড়াকান্দি ঘাটে সৃষ্ট জনজটে চরম দুর্ভোগের শিকার হন তারা।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা যায়, কাওড়াকান্দি, মাঝিকান্দি, কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুট দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৩ জেলার প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে। ঈদে এই সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। যাত্রী ও যানবাহন পারাপারে কাঁঠালবাড়ি শিমুলিয়া নৌরুটে ১৯টি ফেরি, ৮৭টি লঞ্চ ও ১২০টির বেশি স্পিডবোট চলাচল করে। সরেজমিনে গত শুক্রবার কাওরাকান্দি, মাঝিকান্দি লঞ্চঘাট ও কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে দেখা যায়, দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে লঞ্চ ও স্পিডবোটে উঠছেন যাত্রীরা। স্পিডবোটে তোলা হচ্ছে অতিরিক্ত যাত্রী। লঞ্চ ও যাত্রীবাহী বাসগুলো ছাদে যাত্রী বোঝাই করে ঝুঁকি নিয়ে চলছে গন্তব্যে। কাঁঠালবাড়ি ঘাট বাস টার্মিনালেও ছিল ঢাকাগামী যাত্রীদের ভিড়।
যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ফায়ার সার্ভিস, নৌপুলিশ, র্যাব এবং জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের একাধিক টিম কাজ করছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে লঞ্চ, স্পিডবোট ও পরিবহন মালিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। লঞ্চে ঈদ উপলক্ষে ৩০ টাকা ভাড়ার পরিবর্তে রাখা হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। মাঝিকান্দি লঞ্চঘাটে ১০ থেকে ২০ টাকা ঘাট ইজারা নিতে দেখা যায়। যাত্রীদের অভিযোগ, স্পিডবোটের ১২০ টাকার ভাড়া রাখা হচ্ছে ২০০ টাকা। খুলনা থেকে কাঁঠালবাড়ি ঘাটের বাস ভাড়া ২৮০ টাকা। সেখানে রাখা হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা। মাদারীপুর থেকে কাঁঠালবাড়ি ঘাট বা কাওরাকান্দি ঘাট পর্যন্ত যেতে বাস ভাড়া ১০০ টাকার বিপরীতে রাখা হচ্ছে ২০০ টাকা। বরিশাল থেকে কাঁঠালবাড়ি আসতে ভাড়া স্বাভাবিক সময়ে রাখা হতো ২৫০ টাকা। সেখানে ৩৮০-৪৫০ টাকা রাখা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় রওনা হন ফেরদৌস রহমান। তিনি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন। সরাসরি টিকিট না পেয়ে ভেঙে ভেঙে এসেছেন। ফেরদৌস বলেন, কোনোদিন এভাবে-এ পথে আসিনি। সকাল আটায় বাড়ি থেকে বের হয়েছি। শুক্রবার বন্ধের দিন থাকায় ভিড়ের মধ্যে পড়েছি। লঞ্চ আসতে দেরি, তাই অপেক্ষা করছি।
দ্রুত পদ্মা পাড়ি দিতে স্পিডবোটে ভাড়া বেশি দিয়ে বরিশাল থেকে আসা শফিকুল ইসলাম কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে উঠেছেন। তিনি বলেন, সময় কম থাকায় লঞ্চ বা ফেরির জন্য অপেক্ষা করিনি। গাজীপুর যাব অপেক্ষা করার সময় নেই। তাই বেশি ভাড়া দিতে যেতে হচ্ছে। মাওয়া থেকে গুলিস্তান ও মাওয়া থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত সিটিং সার্ভিস বাস-মিনিবাসে ৭০ টাকার স্থলে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা এবং লোকাল বাসের ছাদে ৮০ টাকা আদায় করা হয়।
লঞ্চ মালিক সমিতির মাওয়া জোনের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর চৌধুরী বলেন, আমরা নৌপরিবহনমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে কাঁঠালবাড়ি থেকে শিমুলিয়া নৌরুটে লঞ্চের যাত্রীদের কাছ থেকে ৩০ টাকা করে ভাড়া নির্ধারণ করেছি। যদি কোনো লঞ্চ মালিক সেটা অমান্য করে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে, তবে তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
কাঁঠালবাড়ি লঞ্চঘাটে এম এল দীপু-১ লঞ্চে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ১২০ জন থাকলেও ৪৫০ জন টিকিট বিক্রি করেছেন সুপারভাইজার মো. মোস্তাফা। তিনি বলেন, বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। তবে যাত্রী একটু বেশি যাচ্ছে। লঞ্চযাত্রী ইসমাইল বলেন, শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আজ ফিরছি। যাত্রীর এত চাপ কোনো সিট নেই।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের সদরঘাট টার্মিনালের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, লঞ্চযাত্রীরা ঘাটে নামতে শুরু করেছেন। যাত্রীদের ভিড় আছে। আরো দুই দিন ভিড় থাকবে।
কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী জানান, যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যেই ফিরছে। শিডিউল বিপর্যয় না ঘটায় যথাসময়ে যাতায়াত করতে পেরে যাত্রীরা বেশ খুশি। ঢাকায় আসা প্রতিটি ট্রেন ছিল যাত্রীদের ভিড়ে ঠাসা। এ অবস্থা মঙ্গল বার পর্যন্ত থাকবে।
রাজধানীতে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় : ঈদের আমেজ কটে গেলেও বকশিশের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব চালকরা দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি ভাড়া ছাড়া যাত্রী বহন করছে না। মহাখালী থেকে গাবতলী রুটে চলাচলকারী লেগুনার ভাড়া ২০ টাকার জায়গায় আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। গাবতলী থেকে কুড়িল পর্যন্ত ২৫ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। মিরপুর থেকে সদরঘাটের ভাড়া ৩০ টাকা। কিন্তু গাড়িভেদে আদায় করা হচ্ছে ৫০, ৮০ ও ১০০ টাকা পর্যন্ত। গাবতলী থেকে বিআরটিসির বাসে সাভার পর্যন্ত ২৫ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা ও নবীনগর পর্যন্ত ৩৫ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে ।
জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে দেখা গেছে, বাসে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। রুটভেদে ৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বলে জানান তারা। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসের বিরুদ্ধেও বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা। শেরপুর থেকে ঢাকার ভাড়া ১৮০ টাকা নির্ধারিত হলেও এই রুটে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। গোপালপুর থেকে ঢাকার ভাড়া ২৪০ টাকাস্থলে এখন আদায় করা হচ্ছে ৩৫০ টাকা। নেত্রকোনা থেকে ঢাকার ভাড়া ২০০ টাকা হলেও ৩৬০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বরিশালের ভাড়া ৪৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫২০ টাকা আদায় করা হয়। সৈয়দপুর থেকে ঢাকার ভাড়া বাড়িয়ে ৭০০ ও রংপুর থেকে ঢাকার ভাড়া ৬০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ