সড়ক ও জনপদ বিভাগের (সওজ) কর্মকর্তা ফজলে রব্বের বান্ধবীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে দুই কোটি ১৩ লাখ টাকার বেশি। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল) ইস্কাটন শাখার অ্যাকাউন্টে এই অবৈধ লেনদেন হয় ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছরে।
মোটা অঙ্কের টাকা বিভিন্ন সময় ‘ফ’ আদ্যক্ষরের ওই বান্ধবীর ব্যাংক হিসাবে ঢুকলেও সেই টাকা তুলেছেন অন্য একাধিক ব্যক্তি। এর মধ্যে রয়েছে সওজ কর্মকর্তা ফজলে রব্বে, তার ভাই ফজলে নেওয়াজ, বান্ধবীর ভাই ফয়সাল, মামা শাহিদুল ইসলাম ও খালাতো বোন রিমা। বিভিন্ন সময় চেক ও কার্ডের মাধ্যমে এই টাকা উত্তোলন করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সওজের বরিশাল বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফজলে রব্বে ঘুষের একাধিক লেনদেন করেছেন তার বান্ধবীদের ব্যাংক হিসাবে। নিজের হিসাব পরিচ্ছন্ন রাখতে এই কৌশল নিয়েছিলেন তিনি।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গুরুতর এই অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত শেষে ফজলে রব্বে ও তার স্ত্রীর সম্পদের বিবরণী চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এই বিবরণী জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইউসিবিএলের ইস্কাটন শাখার ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি খোলা হয় ২০১৪ সালের ২০ জুন। তখন ওই অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স ছিল ৫৫ হাজার ৬০০ টাকা। প্রথম বছর তেমন লেনদেন না হলেও পরের বছরের (২০১৫ সাল) ১২ এপ্রিল ওই অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে সাড়ে ৯ লাখ টাকা। এক দিন পর জমা পড়ে পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই লেনদেনের এক মাসের কম সময়ে আবার জমা পড়ে ১ লাখ টাকা।
এরপর অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে টাকা জমা পড়ার হার। ১৭ মে তিন লাখ এবং ২৫ মে এক লাখ টাকা জমা পড়ে। ২ জুন আবার ওই ব্যাংক হিসাবে জমা পড়ে পাঁচ লাখ টাকা। ১৬ জুন ‘ইন হাউজ চেক ডিপোজিট’ হিসেবে জমা পড়ে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। ওই দিন ফয়সাল (‘ফ’ আদ্যক্ষরের বান্ধবীর ভাই) নামে একজন চেকের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা উত্তোলন করে। ১৪ জুলাই বান্ধবীর অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে চার লাখ টাকা।
পরের দুই মাসে এই অ্যাকাউন্ট থেকে ৪৫ লাখ টাকা তোলা হয়। ৯ সেপ্টেম্বর ফয়সাল চেকের মাধ্যমে তিন লাখ টাকা তোলেন। ২০ অক্টোবর ফজলে রব্বে তার বান্ধবীর ব্যাংক হিসাব থেকে ১৫ লাখ টাকা ও তার ভাই চেকের মাধ্যমে ১৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। এ ছাড়া ২৩ নভেম্বর চেকের মাধ্যমে শাহিদুল ইসলাম (বান্ধবীর মামা) ১০ লাখ টাকা ও ২৯ নভেম্বর ফয়সাল দুই লাখ টাকা উত্তোলন করেন।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, ২০১৬ সালে ওই ব্যাংক হিসাবে আবার নগদ ১৫ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়। এক দিন পর চেকের মাধ্যমে ১৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। ১ ফেব্রুয়ারি মিসেস রিমা (‘ফ’ আদ্যাক্ষরের বান্ধবীর খালাতো বোন) চেকের মাধ্যমে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে এক লাখ টাকা তোলেন। একই বছরের ১৩ মার্চ এক লাখ টাকা, ২৪ মার্চ এক লাখ টাকা, ২৬ মে দুই লাখ টাকা, ২৮ জুন সাড়ে ছয় লাখ টাকা, ১৮ জুলাই সাত লাখ টাকা জমা পড়ে।
ফয়সাল নামে এক ব্যক্তি ২৭ জুলাই ১৫ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। ওই বছর কম অঙ্কের টাকা লেনদেন হলেও পরের বছর ২০১৭ সালে ২৩ মে আবার ১২ লাখ টাকা জমা পড়ে। ২৫ সেপ্টেম্বর ৩৮ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।
২০১৮ সালের ১০ জুন আবার ৫ লাখ টাকা জমা পড়ে ব্যাংক হিসাবে। সবশেষ ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর চার লাখ ২৬ হাজার টাকা এবং ২০ নভেম্বর চার লাখ ২৬ হাজার ৬৮২ টাকা ও সাড়ে আট লাখ টাকা জমা পড়ে।
এভাবে সওজ কর্মকর্তা ফজলে রব্বের বান্ধবীর ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময় অস্বাভাবিক লেনদেন হয়। পাঁচ বছরে ওই ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয় দুই কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার ৩৪২ টাকা। সবশেষ বান্ধবীর ব্যাংক হিসাবে থাকা প্রায় বিশ লাখ টাকা আদালতের নির্দেশে ব্লক করে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধান
ফজলে রব্বের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অনুসন্ধান শেষে একাধিকবার তাকে দুদকে তলব করা হয়। এ বছরের শুরুতে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ উপার্জনের অভিযোগের সত্যতা পান তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
প্রথম নজরে আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ শাখার
গত বছরের শুরুর দিকে এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক টাকা থাকার বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বিশেষ শাখার। পরে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানে জানতে পারে, এই টাকা আসলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) বরিশালের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফজলে রব্বের। অবসরে যাওয়া ওই সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রীকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় একাধিকবার। পাশাপাশি ব্যাংকে লেনদেনের সব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে বাহিনীটি।
বরিশালে যাওয়ার আগে ফজলে রব্বে গাজীপুরে নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। ২০১০-১১ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে জয়দেবপুর-মির্জাপুর-টাঙ্গাইল-জামালপুর সড়কে প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামত কাজ করান। মান বজায় রেখে কাজ করা হয়নি- এ অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ফজলে রব্বেকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন দেয়। সে সময় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে সওজ কর্মকর্তা ফজলে রব্বের সঙ্গে একাধিকবার তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।