এইতো সেদিনও আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত ছিল ‘নারী কুড়িতেই বুড়ি’। কারণ, তখন নারীরা সন্তান জন্মদান, প্রতিপালন এবং অবরোধবাসিনীর চেয়ে ভিন্ন কোনো কাজে তাদের অবাধ বিচরণ ছিল না। আজ তারা পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন। বলা যায়, বর্তমানে শিক্ষায় নারীরা পুরুষের সমানে সমান, আবার কৃতিত্বে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং পুরুষের চেয়ে এগিয়ে।
এখন সময় এসেছে অর্থনীতিতে নারীদের পুরুষের সমান সাফল্য দেখানো। তাহলেই কেবল নারী মুক্তি, নারীর স্বাধীনতা, নারীর কর্তৃত্ব ও নারীর ক্ষমতা কার্যকর হবে। কারণ, নারীর ক্ষমতায়ন শুধু আইনে হবে না, চাই অর্থ। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এমনই কিছু তরুণ উদ্যোক্তা নারীর গল্প শুনিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও তরুণ উদ্যোক্তা স্টার্লিং ডি মামুন।
ড চিং চিং
তিনি একজন তরুণ উদ্যোক্তা। রিকশা পেইন্ট, আদিবাসী ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছেন তিনি। ড চিং চিংয়ের ব্র্যান্ডের নাম ‘ফিনারী’।
তিনি বলেন, আমি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে কিছুদিন হলো ইতিহাস বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করেছি। আসলে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর অন্য ১০ জনের মতো আমারও লক্ষ্য ছিল বিসিএসের। কিন্তু এই সোনার হরিণ আমার কাছে অনেক দামি হওয়ার কারণে আশা ছেড়ে দেই। এর মধ্যে শুরু করি আমার বিবাহিত জীবন। আমার স্বামী আমাকে একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন, তারই সাথে কী নিয়ে কাজ করতে পারি তারও একটা পরামর্শ দেন। এরপর আমি সিদ্ধান্ত নেই আমি রিকশা পেইন্ট ও আদিবাসী ফ্যাশন নিয়ে কাজ করব।যেহেতু আমার জন্মস্থান বান্দরবান ও আমি একজন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর হওয়ার কারণে আদিবাসীদের খুঁটিনাটি জানা আমার জন্য সহজ ছিল। তাই যেই ভাবনা সেই কাজ, শুরু করে দিলাম।
প্রথমে আমি সামাজিক মাধ্যমে ২০১৬ সালে একটা পেইজ খুলে ওখানে আমার উদ্যোগের পণ্যগুলো আপলোড দিতে থাকি, সেক্ষেত্রে আমাকে সহযোগিতা করেছে আমার বন্ধুরা। তাই একজন উদ্যোক্তা সে যেই হোক না কেন, তার সাথে পরিবার, বন্ধুর মানসিক ও সামাজিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন।
উদ্যোগের শুরুর দিকে আমি যেমন পরিবার ও বন্ধুদের সহযোগিতা পেয়েছি, আর এখন আমি উদ্যোক্তা বন্ধুদের ও সাথে সাথে অনেক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেয়ে থাকি। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ না করলেই নয়- বিডিওএসএন, এসএমই ফাউন্ডেশন, বিডি বি’ইয়া, মাইডাস ফিন্যান্স ও বিভিন্ন জনপ্রিয় নারী সংগঠন। আমি এদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে খুবই ভালো আছি।
তাহমিনা কবির
আমি হোম ইকোনমিকস কলেজে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও এন্ট্রাপ্রেনারশিপ বিভাগের ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। সাথে যব, পাট ও পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজ করছি। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম ডলি’স। চাকরি করার কথা কখনো ভাবিনি। ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করার সময় যখন হয়েছে, ঠিক তখন থেকেই নিজেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট (স্বাধীন) করতে চেয়েছি।
এখন বিজনেস ভালো হচ্ছে। অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু কর্মীও আছে।নিজের পাশাপাশি অন্যদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পেরেছি, যারা আমাকে দেখে ভাবে নিজে কিছু করবে। বিভিন্ন কর্পোরেটের সাথে কাজ করছি।
সাজিয়া রহমান
স্বপ্নবাজ নারী সাজিয়া আবুজর গিফারি কলেজ থেকে পড়া লেখা শেষ করেছেন। তিনি কর্মমুখী দক্ষতা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, বরাবরই স্বাধীন চেতা মানুষ ছিলাম।বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মমুখী করে তোলার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা। বর্তমানে অনেক ভালো আছি।আমার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেক যুব/যুব মহিলাদের আত্মকর্মী হিসেবে তৈরি করেছি। অনেকেই চাকরির পেছনে না ছুটে আত্মকর্মসংস্থান গড়ে তুলেছেন।
তাহমিনা আরফিন অর্পিতা
অত্যন্ত পরিশ্রমী, বুদ্ধিদীপ্ত ও ন্যায়পরায়ণ একজন মানুষের নাম তাহমিনা আরফিন। নিত্য নতুন ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে কাজ করছেন তিনি। পিতৃ বিয়োগের পর স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় ও নিজ প্রচেষ্টায় যিনি আজ একজন সফল উদ্যোক্তা।
ছাত্র অবস্থায় লেখাপড়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেছেন তাহমিনা আরফিন এবং চাকরি করার পাশাপাশি কীভাবে উদ্যোগ নিতে হয় তা তিনি শিখেছেন। স্নাতোকোত্তর শেষে ২০১৭ সালে নিজে কিছু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তিনি। নিজেই তৈরি করতেন পণ্য এবং তৈরিকৃত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে বিপণন কর্ম সম্পন্ন করতেন। এ সমস্ত কর্মকাণ্ডে ছায়ার মতো পাশে থেকে উৎসাহ যুগিয়েছেন তাহমিনা আরফিনের জীবনসঙ্গী; যার সহযোগিতা না পেলে তিনি হয়তো উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আরো বেগ পেতে হতো।
বাংলাদেশ ইয়ুথ এন্টারপ্রাইজ অ্যাডভাইস অ্যান্ড হেল্প সেন্টার (বি’ইয়া), এসএমই ফাউন্ডেশন ও ই-ক্যাব থেকে প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন তিনি। দক্ষ হাতে পণ্য তৈরি ও বিপণন কার্য সম্পাদন করে তিনি সফল হয়েছেন।
বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করে অর্ডার পেয়ে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করেছেন এই সফল উদ্যোক্তা। ভবিষ্যতে কারখানা প্রতিষ্ঠা করে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন তাহমিনা আরফিন।
বাংলাদেশের এসএমই খাতের সকল পণ্য নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। দেশের পণ্য যেন দেশের বাজার ছাড়িয়ে বিদেশে সম্মানজনক স্থান দখল করতে পারে, সেই প্রত্যাশায় কাজ করতে চান এই সফল নারী উদ্যোক্তা।
লাবনী আহমেদ
চাঁদপুর জেলা শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লাবনী। বাবা জহিরুল ইসলাম খান একজন সরকারি চাকরিজীবী। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। খুব আদরে বড় হন ঢাকার যাত্রাবাড়ি নিজের বাড়িতে।
তিনি বলেন, আমার যখন ৪ বছর বয়স, তখন হঠাৎ করে বাবা মারা যান।ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি মায়ের সংগ্রামী জীবন। আমার স্কুলজীবন শুরু হয় শেখদী এ এম উচ্চ বিদ্যালয়ে। মায়ের কাছ থেকে শেখা সেলাইয়ের কাজ। শখ করে নিজের জন্য, বোনদের জন্য সেলাই করতাম বিভিন্ন ডিজাইনের জামা।সুতার কাজ, ব্লক, বাটিক। লেখাপড়ায় ছিলাম মোটামুটি।
দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।পরীক্ষা দেওয়ার আগে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।সবাই তাড়াহুড়ো করে পরীক্ষার পর আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন।স্বামী সৈয়দ বেনজীর আহমের প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করেন। বিয়ের পর অনার্স শেষ করি। কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে একটা মেয়ে সৈয়দা নাফিসা তাবাসসুম। পাচঁ বছর পর ছেলে সৈয়দ রাইয়ান রাহিম। সুখেই কাটছিল জীবন। কিন্ত সুখ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন।চাকরি চলে যায়। যা জমানো ছিল সব শেষ হয়ে যায় স্বামী আর সংসার খরচে। মেয়ে তখন এসএসসি দিবে। মেয়ের স্বপ্ন বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু তাকে কোনো শিক্ষা দিতে পারি নাই।ফরম ফিলাপের টাকা জোগার করতে পারছিলাম না। শেষ সম্বল একটা গলার চেন আর নাকের ফুল বিক্রি করি। মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারি নাই।ও এইচএসসি বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে কলেজে ভর্তি হলো।
হাতে কিছু টাকা ছিল আর এক ভাই কিছু দিলো। ২০১৫ সালে মাত্র ২০,০০০ টাকা নিয়ে ব্লক এ ড্রেস তৈরি করে একটা অনলাইন পেইজ খুলি। কিন্তু তেমন সাড়া পেলাম না। পরে ব্যাগে ভরে কাঁধে নিয়ে আত্নীয়দের বাসায় গিয়ে বিক্রি করা শুরু করি। ভালো সাড়া পেলাম। সেই থেকে শুরু। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছি। অনেক কথা শুনেছি। আত্মীয়-স্বজন বলা শুরু করলো জামাই বসে বসে বউয়ের কামাই (ইনকাম) খান। তখন সে ছোট্ট একটা চাকরি নেয়। অল্প বেতন।খেয়ে না খেয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনেক সংগ্রাম করেছি।
আমার স্বামী আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। ইসলামপুর, চক বাজার, বাবু বাজার, কেরানীগঞ্জ সব জায়গায় ওকে নিয়ে গেয়েছি পাইকারিতে কোথায় কমে পাওয়া যায়। অনেকগুলো কোর্স করেছি। বিসিক, এসএমই, যুব উন্নয়ন থেকে। ই-কর্মাস ট্রেনিং নিয়েছি। ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল একটা বুটিক সপ দেব। আমার স্বামী আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করে দিলো।কিছু টাকা আমি জমিয়েছি, আর কিছু সে জোগাড় করে লাবণ্য ক্র্যাফটস নামে একটা শো-রুম করি। সাথে একটা ছোট কারখানা। সেখানে ১০/১২ জন মেয়েকর্মী কাজ করে।
সেই আমি পল্লিমা মহিলা পরিষদ থেকে নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার পেয়েছি। YSSE থেকে পুরস্কার। E-Club Women Forum-এ আমি এখন কো-চেয়ারম্যান। নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করি। তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হই। কিন্তু থেমে থাকিনি।
শত প্রতিকূলের মধ্যে ধৈর্য্য ধরে টিকে থাকাই সফলতা। ধৈর্য্য, নিষ্ঠা, জেদ আর লক্ষ্য থাকলে সফলতা আসবেই। আমি কেন পারবো না। আমাকে পারতেই হবে, এই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেলেই জীবনে সফলতা আসবে আসবেই। নারী হয়ে কাজ করতে গেলে অনেক বাধা আসবে। শত বাধা পেরিয়ে সামনে যেতে হবে। মোট কথা লেগে থাকতে হবে।
জয়া ইসলাম
তিনি কলেজ অব হোম ইকোনমিকসে পড়াশোনা করছেন। উডেন হ্যান্ডক্রাফটস তার প্রতিষ্ঠানের নাম।
জয়া বলেন, সত্যি কথা বলতে জব ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন কখনোই দেখিনি, স্বপ্নতো ছিল ডক্টর হওয়ার। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না। তবে, একটা স্বপ্ন ভাঙা মানে তো হেরে যাওয়া নয়, জীবনটা চ্যালেঞ্জিং! বেঁচে থাকার জন্যই তো লড়াই। এটি খুবই দুঃখজনক যে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষ বেকার। এ সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলছে, যা একটি পরিবারসহ দেশের জন্য অভিশাপ। কাজেই চাকরির আশা ছেড়ে নিজেই কিছু করার চেষ্টা করাটাই উত্তম বলে মনে করেছি। আর তাই আজ উদ্যোক্তা হতে চেয়েছি, যেন চাকরির পেছনে না ছুটে মানুষকে চাকরি দিতে পারি।
এখন ভালো আছি। নিজের খরচ নিজে চালাচ্ছি, বাবা-মাকে আমার জন্য অতিরিক্ত প্রেসার নিতে হচ্ছে না। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের সার্বিক যোগান নিজেই দিতে পারছি। প্রয়োজনে বাবা-মায়ের পাশে থাকতে পারছি। সন্তান হিসেবে এটাই তো জীবনের সার্থকতা, বাবা-মাও আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। এইতো এটুকুই।
রেশমা জাহান
ইতোমধ্যে তিনি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন। স্বপ্নকথা কুটির শিল্প তার প্রতিষ্ঠানের নাম।
তিনি বলেন, স্কুলে শিক্ষকতা করতাম, পরে মনে হলো উদ্যোক্তা হবো, সেই চিন্তা থেকে ২০০৯ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন ডিস্ট্রিকে গিয়ে নারীদের নিয়ে কাজ করি এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেই। আমি চাই আমাদের দেশের প্রতিটি মেয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলুক। এখন নিজের ব্যবসার পাশাপাশি অসহায়দের নিয়ে সামাজিক বিভিন্ন কাজ করছি। এখন ভালো আছি।
মোসাম্মাত আমেনা বেগম
আমি স্কুল শেষ করেছি। বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠান ‘আমির টেইলারস অ্যান্ড ফেব্রিকস’ এ কাজ করছি। যখন জব করতাম সময় মেপে চলা, পরের অধীনে থাকা, কাজের নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা নেই, শ্রম অনুযায়ী মজুরি নেই।সব কিছুই সহ্য করতে হতো। নিজের দক্ষতা দিয়ে কিছু করা, এটা মাথায় ঘুরপাক খেতো। এটা এমন না হয়ে অমন হলে ভালো হতো।
আজ উদ্যোক্তা হয়ে সব কিছু নিজের মতো করতে পারছি, আরো কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারছি। আগে লিমিটেড সময়ে লিমিটেড আয়ের উপর চলা কঠিন হতো। এখন তা নেই, বন্দিজীবন থেকে বের হয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করে কাজ করতে পারছি। চাকরিজীবনের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছি।