বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ১২ ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণেই ব্যংকিং খাতে বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ। তারা বলছেন, যেসব ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না সেইসব ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় মূলত আমানতকারীদের জন্যই। কিন্তু যেসব ব্যাংক প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে অবশ্যই সেই সব ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন ঝুঁকিতে আছে।
তিনি উল্লেখ করেন, এখন ওই ব্যাংকের উদ্যোক্তারা প্রভিশন ঘাটতির সমান টাকা ব্যাংকের তহবিলে জমা দেবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হলো- প্রভিশন ঘাটতির টাকা জমা না দেওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সুযোগ বন্ধ করে দেবে।
এ প্রসঙ্গে পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, প্রভিশন সংরক্ষণ করাই হয় আমানতকারীদের স্বার্থে। কোনও ব্যাংক যদি প্রভিশন রাখতে না পারে, তাহলে দুশ্চিন্তায় পড়ে আমানতকারীরা। এ কারণে ব্যাংকগুলোর উচিত প্রভিশন ঘাটতি দ্রুত মিটিয়ে ফেলা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোতে ঋণের ঝুঁকি বিবেচনায় প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৬১ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো প্রভিশন রেখেছে ৫৪ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৬ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, ব্যাংক ব্যবস্থার খেলাপি ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতির অর্থ সংরক্ষণের বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনও প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এই প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। তবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লে, ব্যাংকের প্রয়োজনীয় আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট শ্রেণিকৃত ঋণের মধ্যে ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৮৬ দশমিক ৮০ শতাংশই মন্দ বা ক্ষতিজনক ঋণ। যা একবছর আগে ছিল ৮০ হাজার ১১৬ কোটি টাকা বা ৮৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনও লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।
কোন ব্যাংকের কত ঘাটতি:
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এছাড়াও ঘাটতি রয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ৪৪২ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৩৩৪ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৮৭৮ কোটি, এবি ব্যাংকের ৬৩৭ কোটি, বাংলাদেশ কর্মাস ব্যাংকের ৫৩৮ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৪২৫ কোটি, মিউচ্যুায়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৭৫ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৪৮৭ কোটি, এসআইবিএলের ২৯৬ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৬১ কোটি এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৬৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, এক বছরের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৪০ কোটি টাকা। বর্তমানে ঘাটতি ৬ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে এই ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি টাকা।