ঋণখেলাপিদের রাশ টেনে ধরতে এবার নতুন একটি সংস্থা গঠন করতে যাচ্ছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে এ সংস্থার চেয়ারম্যান করা হবে। আর এর সদস্য সংখ্যা হবে ১০ জন। সংস্থাটির নামকরণ করা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন।’ সংস্থাটির পরিশোধিত মূলধন হবে তিন হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে একটি আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এই সংস্থা গঠনের মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ ও বিক্রি করার ক্ষমতা দেয়া হবে। এতদিন এ ধরনের ক্ষমতা শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের ছিল। সংস্থাটিকে খেলাপি ঋণের পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনেরও ক্ষমতা দেয়া হবে নতুন আইনে। এদের যেকোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ কিনে নিতে পারবে। এছাড়া, সংস্থাটির আয় ও মুনাফা হবে সম্পূর্ণ করমুক্ত।
সূত্র জানায়, এটি কোনো খেলাপি প্রতিষ্ঠানের ‘রিসিভার’ হিসেবেও কাজ করতে পারবে। সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে গঠিতব্যপরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (সিইও) নিয়োগ দেবে সরকার।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ার ওপর শিগগিরই বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে মতামত নেবে। এরপর আইনটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী বাজেট অধিবেশনে আইনটি সংসদে পাস করতে উপস্থাপন করা হবে। সংস্থাটিকে একটি ‘বিধিবদ্ধ’ সংস্থা হিসেবে বর্ণনা করে আইনে বলা হয়েছে, ‘এই করপোরেশনের একটি সিলমোহরও থাকবে এবং করপোরেশন মামলা দায়েরও করতে পারবে।’
সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হবেন পদাধিকার বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। তার অধীনে পর্ষদে সদস্য হিসেবে থাকবেন অর্থ বিভাগের একজন যুগ্মসচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন সদস্য, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন সদস্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের একজন সদস্য, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মনোনীত একজন সদস্য। সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও একজন সদস্য হিসেবে থাকবেন। পর্ষদের মেয়াদ হবে তিন বছর।
সূত্র জানায়, ২৯ পৃষ্ঠার এই আইনে ধারা রয়েছে মোট ৪৬টি। এর ২৪ ধারায় বামকোকে ‘নন-পারফর্মিং ঋণ বা খেলাপি ঋণ আদায় ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ননপারফর্মিং ঋণ আদায় ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এই কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ব্যবসায়ের যথাযথ দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বা কর্তৃত্ব গ্রহণ এবং ঋণগ্রহীতার ব্যবসায়ের সম্পূর্ণ বা আংশিক বিক্রি বা লিজ প্রদান। ঋণগ্রহীতার ননপারফর্মিং ঋণের পুনঃতফসিলীকরণ কিংবা পুনর্গঠন করতে পারবে সংস্থাটি। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতার বকেয়া নিষ্পত্তি করবে। এছাড়া, জামানতের দখল, সুরক্ষা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে লিজ বা বিক্রি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ঋণগ্রহীতার গৃহীত ঋণের গুণগত মান বিবেচনা করে, সম্পূর্ণ বা যে কোনো অংশ শেয়ারে রূপান্তরকরণ করতে পারবে করপোরেশন।
এই আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন’ অর্থ এই আইনের অধীন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নন-পারফর্মিং ‘জামানতী ঋণ বা অগ্রীম’ক্রয়, বিক্রি, সংরক্ষণ, আদায়, পুনর্গঠন, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সম্পদের সিকিউরিটাইজেশন ও ব্যবস্থাপনা। আর প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের বিএমআরই, পরামর্শ প্রদান এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা মূলধন বা উদ্ভাবন মূলধন প্রদান ও ব্যবস্থাপনাকারী কোনো বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও এটি বিবেচিত হবে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘করপোরেশন একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হবে এবং এই আইনের বিধান সাপেক্ষে, এর স্থাবর ও অস্থাবর, উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করার, অধিকারে রাখার এবং হস্তান্তর করার ক্ষমতা থাকবে এবং করপোরেশনের নিজ নামে মামলা করতে পারবে।’ খেলাপি ঋণ আদায়ে বা হ্রাস করার জন্য এই করপোরেশন যেকোনো দেশি বা বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে। এই করপোরেশনের তালিকাভুক্তি ছাড়া অন্য কোনো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কাজ করতে পারবে না। সংস্থাটির সদরদপ্তর ঢাকায় হবে, কিন্তু শাখা অন্যান্য জায়গাও হতে পারে।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনের কার্যাবলী : আইনের খসড়ায় বলা হয়ছে ঋণগ্রহীতা রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের বিএমআরই এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, দেউলিয়াবিষয়ক আইন, ১৯৯৭-এর ধারা ৭৪ অনুযায়ী ‘সরকারি রিসিভার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া, সংস্থার ঋণগ্রহীতা প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন, পোর্টফোলিও এবং সম্পদের পুনর্গঠন করতে পারবে। ঋণগ্রহীতার সম্পদ বা জামানত অর্জন, নিষ্পত্তিকরণ এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ঋণগ্রহীতার দেউলিয়াগ্রস্থ অবস্থা চিহ্নিতকরণ ও সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
করপোরেশনের শেয়ার মূলধনের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, করপোরেশনের অনুমোদিত শেয়ার মূলধন হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। করপোরেশনের পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা। উভয় মূলধন সরকারের অনুমোদনক্রমে, সময় সময় বৃদ্ধি করা যাবে।
তহবিল বা ফান্ড গঠন ও পরিচালনা : প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে ‘‘করপোরেশন প্রয়োজনে ক্যাপিটাল মার্কেট হইতে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল বা ফান্ড সংগ্রহ করতে পারবে। করপোরেশন তহবিল বা ফান্ড গঠন বা বৃদ্ধিকল্পে, এক বা একাধিক, দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি বা ফান্ড ম্যানেজারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে। তবে এরূপ দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারী বা ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনের অধীনে ‘জেনারেল পার্টনার’ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং করপোরেশনের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তহবিল বা ফান্ডের আর্থিক ব্যবস্থাপনা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করবে।’’