২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১২:২১

নৃশংস এক উৎসব থেকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

আজ থেকে কয়েক শতাব্দী পূর্বে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে ঘটত নৃশংস এক ঘটনা। ‘লুপেরা সালি’ নামে প্রাচীন রোমে এই দিনে উৎসব হতো। সেখানে নারীদের প্রথমে অত্যাচার করা হতো এবং পরবর্তী সময়ে সঙ্গমে বাধ্য করা হতো।

কাজটি করা হতো মূলত নারীদের সন্তান ধারণে সক্ষমতার প্রচার প্রচারণা চালানোর জন্য। যদিও বহু যুগ পরে এসে দিনটি ‘ভালোবাসা’ শব্দটির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তবে এর শুরুটা মোটেই ভালোবাসা পূর্ণ ছিল। এই দিনে প্রথমে নারীদের মৃত পশুর কাঁচা চামড়া দিয়ে তৈরি চাবুক দিয়ে বেত্রাঘাত করা হতো। সে সময় সামাজিক বিশ্বাস ছিল, এর মাধ্যমে নারী কোনো জটিলতা ছাড়াই সন্তান ধারণ করবে এবং পরে খুব সহজেই সেই সন্তান প্রসব হবে। উৎসবের বীভৎসতা এখানেই শেষ নয়। লটারির মাধ্যমে সঙ্গী নির্বাচন করা হতো। সেই সঙ্গীর সঙ্গে মিলন বাধ্যতামূলক। এবং যতক্ষণ উৎসব শেষ না হতো ততক্ষণ চলত এই পাশবিক অত্যাচার।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে লুপেরা সালি উৎসবের সূচনা। এই দিনের শুরুতে বেশ কয়েকজন রোমান পাদ্রী নগ্ন হয়ে প্রথমে যৌনতাকে উৎসর্গ করে ছাগল বলি দিত। এরপর কুকুর বলি দিত শুদ্ধতাকে উৎসর্গ করে। এদের মধ্যে দুজন পাদ্রী সেই রক্তে মাখা ছুরি থেকে রক্ত নিয়ে কপালে লাগাতেন।এরপর দুধে ভেজা উলের কাপড় দিয়ে সেটা মুছে ফেলতেন।

বলি শেষ হওয়ার পর উৎসবের আরো অন্ধকার দিক বের হয়ে আসত। পাদ্রীরা তখন মৃত পশুর চামড়া লম্বা করে কেটে রক্তে ভিজিয়ে রাখত। উল্লেখ্য যে, সেই রক্ত আশীর্বাদের মাধ্যমে পবিত্র করে নেয়া হতো। এরপরই চাবুকের মতো লম্বা সেই চামড়া হাতে পাদ্রীরা রাস্তায় বের হয়ে যেত। সেখানে বিভিন্ন নারী সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত এবং পাদ্রীরা তাদের আঘাত করত। নারীদের নীরবে এই অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিল না। কেননা তারাও বিশ্বাস করত- এর মাধ্যমে তারা নিরাপদভাবে সন্তান ধারণে সক্ষম হবে। এজন্য অনেকে নিজ থেকেই এগিয়ে গিয়ে শরীরের কাপড় সরিয়ে দিতো যাতে সেখানে পাদ্রীরা চাবুক মারতে মারে।

কথিত আছে, এরপরই সঙ্গী খুঁজে নেয়ার লটারি শুরু হতো। অবিবাহিতা নারীদের নাম একটি পাত্রে রেখে, অবিবাহিত পুরুষদের বলা হতো একটি নাম উঠিয়ে নেয়ার জন্য। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই উৎসবে সঙ্গীর সাথে জোড়া বাধার পর দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হতো নারীদের। দিনে দিনে উৎসবের মাহাত্ম্য বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং রীতিনীতির মধ্যেও চলে এলো কিছু পরিবর্তন। তখন আর পাদ্রীদের নগ্ন হতে হতো না এবং নারীদের শুধু হাতে বেত্রাঘাত করা হতো। কিছুদিন আগে নেটফ্লিক্স-এর তৈরি ‘দ্য চিলিং অ্যাডভেঞ্চার অব সাবরিনা’ নামক একটি টিভি সিরিজে এই উৎসবের বেশ কিছু রীতিনীতি দেখানো হয়েছিল।

সে যাই হোক, রোমান এই উৎসবের তারিখ ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। পরবর্তী সময়ে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে এর নামকরণ করা হয়- ভ্যালেন্টাইন ডে। একটি তথ্য অনুযায়ী, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রোমান পাদ্রী ছিলেন এবং তিনি তৎকালীন তরুণ-তরুণীদের মধ্যে গোপনে বিয়ে দিতেন। এই গল্পটা শুরু হয় খ্রিস্টাব্দ ২৬৮-২৭০ এর দিকে ক্লডিয়াস-২ এর শাসনামলে। ক্লডিয়াস মনে করতেন, অবিবাহিত পুরুষরা বিবাহিত পুরুষদের থেকে ভালো সৈন্য হতে পারে। এ কারণে তিনি তরুণদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ঠিক তখনই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রাজনির্দেশ অমান্য করে এই কাজের সূচনা করেন। কাজটি তিনি লুকিয়ে করতেন এবং একদিন ধরা পড়ে যান।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে তখন জেলে ভরা হয়। উল্লেখ্য যে, ভ্যালেন্টাইন ক্লডিয়াসের এই আইন অমান্য করার পাশাপাশি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ব্যাপারেও অনেককে উৎসাহ দিয়েছিলেন ইতিপূর্বে। এমনকি জেলের মধ্যে থেকেও তিনি ক্লডিয়াসকে খ্রিস্টান হওয়ার জন্য আহ্বান করেন। এতে রাজা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, হয় ভ্যালেন্টাইনকে নিজের ধর্মবিশ্বাস থেকে সরে আসতে হবে অথবা মৃত্যুবরণ করতে হবে।

ইতিহাসবিদদের মতে, জেলে থাকা অবস্থায় ভ্যালেন্টাইনের সাথে জেলারের কন্যার সখ্য গড়ে ওঠে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সেই কন্যার জন্য একটি চিঠি লিখে যান। যেখানে লেখা ছিল ‘ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন’। কথিত আছে, ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুও হয়েছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। এভাবেই একটি বীভৎস উৎসব ধীরে ধীরে চমৎকার ভালোবাসাপূর্ণ একটি দিবসে রূপান্তরিত হয়।

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০ ১:৪৬ অপরাহ্ণ