পাঁচ বছর বয়সী ওমর ফারুক নামে এক শিশুর ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে দুই বছর আগে। কিন্তু অর্থাভাবে এই পরিবারটি সেভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারছে না।
রেহানা আক্তারের দুই সন্তানের মধ্যে ওমর ফারুক দ্বিতীয়। বড় মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোট সন্তানকে নিয়ে ঢাকা-ফেনী যাতায়াত করছেন তিনি।
গত বুধবার একটি টেস্ট রিপোর্টের ফলাফল পাওয়ার কথা ছিল, তাই আবার ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন মা রেহানা আক্তার। আছেন বাংলামোটরে অবস্থিত শিশু ক্যানসার রোগীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত আশিক (অ্যা সেন্টার ফর হেল্পলেস ইল চিলড্রেন ফাউন্ডেশন ফর চাইল্ডহুড ক্যানসার) ফাউন্ডেশনে ।সেখানে বসেই কথা হয় রেহানা আক্তারের সঙ্গে।
কীভাবে ক্যানসার ধরা পড়লো জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিন মাসের মতো জ্বর হতো কয়দিন বাদেই। জ্বর আসে আবার যায়।
রেহানা আক্তার আরও বলেন, আমরা গ্রামের মানুষ, এই ধরনের রোগের কথা জানিও না। একরাতে ছেলের ভীষণ জ্বর হলো। এরপর ডাক্তারের কাছে গেলাম, তিনি ওষুধ দিলেন। তাতে কমলো না, আবার গেলাম। এবার টেস্ট দিলেন। এভাবে কয়েকবার ডাক্তারের কাছে গেলাম, ওষুধ দিলেন, টেস্ট দিলেন-কিছুতেই কিছু হয় না। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গেলেন ফেনীতে। তাকে দেখালাম। তিনি বললেন, আপনারা ভয় পাবেন না, এ রোগের চিকিৎসা আছে কিন্তু টাকাপয়সা লাগবো। পরে তিনি ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) আসার জন্য বললেন।
রেহানা আক্তার বলেন, ঢাকায় এসে জিজ্ঞাস করলাম-স্যার আমার ছেলের কী অসুখ ধরা পড়েছে? চিকিৎসক বললেন, ওর (ফারুক) ব্লাড ক্যানসার। হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, যদিও ট্রিটমেন্ট থাকে, কিন্তু সে ট্রিটমেন্ট করানোর সামর্থ্য নেই আমাদের। দুই বছরে প্রায় সাত থেকে আট লাখ টাকা চলে গেছে বলেও জানান রেহানা আক্তার।
সাত বছর তিন মাসের শেফা খাতুনের বাবা আব্দুল মোমেন। সিরাজগঞ্জে ছোট এক ফার্মেসি চালিয়ে সংসার চালান। প্রায় আট মাস ধরে শেফার চিকিৎসা চলছে বেসরকারি এক হাসপাতাল আর পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।.
আব্দুল মোমেন বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করালে আমার মেয়ের সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় ৬০ ভাগ। তখন নামলাম চিকিৎসাতে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
আব্দুল মোমেন আরও বলেন, একটা ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী যে পরিবারে থাকে, সে পরিবার আর্থিক আর মানসিকভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়। এটা ভুক্তভোগীদের পক্ষেই কেবল সম্ভব, আর কেউ বুঝবে না।
একইকথা বলছেন, ১২ বছরের সিফাত হাসানের মা রোমেলা বেগম। প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক রোমেলা বেগম বলেন, ক্যানসার যাকে খায়-একটু একটু করে খায়।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। এরমধ্যে শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। তবে দেশে কত সংখ্যক শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত সে সম্পর্কে সঠিক কোনও পরিসংখ্যান না থাকলেও বর্তমানে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ শিশু ক্যানসার রোগী রয়েছে। আর প্রতি বছর নতুন করে যোগ হচ্ছে ১৩ হাজার শিশু। এত শিশু আক্রান্ত হলেও তাদের জন্য দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল।
তারা আরও বলছেন, দেশের মোট ১০টি সরকারি হাসপাতালে শিশু ক্যানসার রোগীদের জন্য চিকিৎসা সেবা থাকলেও সব জায়গাতে বিভিন্ন কারণে সেবা পাওয়া যায় না। একইসঙ্গে এসব হাসপাতালে চিকিৎসক আছেন মোটে ২৫ জন। আর রোগ নির্ণয়ের আওতায় আসে শতকরা ২৫ ভাগ শিশু।
তারা বলেন, ২০০৫ সালে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা গিয়ে ঠেকবে ১৩ শতাংশে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোর্শেদ খসরু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৯ সালে এই হাসপাতালে মোট ৫৬৭ জন শিশু ক্যানসার রোগী ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে নতুনভাবে আক্রান্ত হয়েছে ১৬৮ জন, যা কিনা শতকরা ৩০ শতাংশ। মোট আক্রান্তদের মধ্যে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে ২৪০ জন শিশু, যা কিনা ৪২ শতাংশ। লিম্ফোমাতে আক্রান্ত হয়েছে ১১৩ জন, যা কিনা শতকরা ২০ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য ক্যানসারগুলো হচ্ছে- কিডনি, নিউরোব্লাসটোমা, জার্ম সেল টিউমার, মাসেল ক্যানসার এবং বোন ক্যানসার। এরমধ্যে লিম্ফোমা, কিডনি, ব্লাড এবং জার্ম সেল টিউমার- এ আক্রান্ত শিশুরাই বেশিরাভাগ সুস্থ হয়ে থাকে।’
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মমতাজ বেগম বলেন, ‘শিশু ক্যানসার বিশেষজ্ঞের সংখ্যা আমাদের দেশে একেবারেই হাতে গোণা। যতটুকু চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে দেশে অনেক কম চিকিৎসক আমাদের।’
বাংলাদেশে শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসা কতটুকু রয়েছে—জানতে চাইলে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক হাবীবুল্লাহ তালুকদার বলেন, ‘সার্বিকভাবে যেমন ক্যানসারের চিকিৎসা পুরোপুরি নেই, তেমনি শিশুদেরও নেই। তবে সম্প্রতি শিশুদের ক্যানসরা চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। যেমন, শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য পৃথক বিভাগ হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে পৃথক বিশেষজ্ঞও।’ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশপাশি শিশু ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদের সংখ্যা বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা শহরের হাসপাতালেও বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।