ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও কনকর্ড আর্কেডিয়া শপিংমলের ভবন দুটি পাশাপাশি। ২০০২ সালে কনকর্ড আর্কেডিয়া চালুর পর একে একে এর শতাধিক দোকান কিনে নেয় ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ। কেনার পর মার্কেটের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় হাসপাতালের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে তারা। মালিক সমিতি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ— রাজউকের নকশা অমান্য করে মার্কেটে হাসপাতাল বানাচ্ছে ল্যাবএইড। মার্কেটের বড় অংশ হাসপাতালে রূপান্তর এবং কিনে রাখা অনেক দোকান মাসের পর মাস বন্ধ রাখায় সেখানে কেনাকাটা করতে ক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছেন। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। এভাবে ব্যবসায়ীদের বেকায়দার ফেলে বাকি দোকানগুলো কিনে নেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।
এ নিয়ে গত ২১ জানুয়ারি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে কনকর্ড আর্কেডিয়ার মেইন গেটের গ্লাসডোর, ভবনের পশ্চিম পাশের ব্যাংক বুথ, লিফট ও নিচতলার ১০১ নম্বর দোকানে ভাঙচুর করা হয়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দু’পক্ষের লোকদের আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। রাতেই উভয়পক্ষ মামলা দায়ের করলে সেই মামলায় আটক ব্যক্তিদের গ্রেফতার দেখানো হয়।
এ বিষয়ে কনকর্ড আর্কেডিয়া শপিংমল ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সানাউল হক নীরু বলেন, ‘রাজউকের লে-আউট প্ল্যান ও ডেভেলপারের ঘোষণা অনুযায়ী শপিংমলটির একটি বেইজমেন্ট, নিচতলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনড মার্কেট এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা অফিসের জন্য বরাদ্দ ছিল। শপিংমল চালুর প্রাথমিক পর্যায়ে ২০৪টি দোকানের মধ্যে নিচতলার ৪১টি, দোতলায় ২৪টি, তৃতীয় তলার ১২টি এবং চতুর্থ তলার ৩১টি দোকান এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় অফিস, ডাক্তারের চেম্বার, কোচিং সেন্টার ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ দেওয়া হয়। হঠাৎ ২০০৫ সালে আমরা জানতে পারি, মার্কেটের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার ১০২টি দোকান এবং পঞ্চম তলার ৭ হাজার বর্গফুট অফিস স্পেস কিনে নিয়েছেন ল্যাবএইডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এএম শামীম। কেনার পর মার্কেটের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলার অংশ ভেঙে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত করে নেয় তারা। ওই ফ্লোরগুলোতে সাধারণ ক্রেতা ও মার্কেটের সংশ্লিষ্ট লোকজনের চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজউক চতুর্থ তলা পর্যন্ত মার্কেটের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু ল্যাবএইড জোর করে হাসপাতাল বানিয়ে ফেলছে।’
জানা গেছে, দোকান কিনে জোর করে মার্কেটের অংশে হাসপাতাল বানানোর অভিযোগে ২০১১ সালের ২৮ আগস্ট ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। এর আগে রাজউকের অনুমোদিত নকশা বহির্ভূত নির্মাণকাজের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে কনকর্ড আর্কেডিয়া শপিংমল ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ২০০৮ সালের ১৩ জানুয়ারি সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এরপর ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর রাজউকের অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটানোর কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি চূড়ান্ত নোটিশের মাধ্যমে শপিংমলের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার নকশা বহির্ভূত স্থাপনা নিজ খরচে ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হয় ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষকে। এরই মধ্যে ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর মার্কেটের জমির মালিক ও ল্যাবএইডের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে কনকর্ড আর্কেডিয়া শপিংমল ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। শুনানি শেষে ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেন আদালত। মামলাটি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।
মার্কেটের অংশ ভেঙে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত করার পাশাপাশি ভবনের সার্ভিস চার্জ দেওয়া বন্ধ করে দেয় ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ। সানাউল হক নীরু বলেন, ‘ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষের কাছে ২০১২ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সার্ভিস চার্জ বাবদ বকেয়া রয়েছে পাঁচ কোটি তিরাশি লাখ নব্বই হাজার পাঁচশ চুরাশি টাকা।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় শপিংমলটি পাঁচ দিন বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে দ্বিতীয় তলার ২০৮ নম্বর দোকানের পেছনের অংশ ভেঙে ল্যাবএইডের সঙ্গে করিডোর নির্মাণ করেছে। সেখানে কলাপসিবল গেটও লাগানো হয়েছে বলে জানান কনকর্ড আর্কেডিয়া শপিংমল ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ আহম্মেদ বাবু। তিনি বলেন, ‘এভাবে একের পর এক মার্কেটের দোকান ল্যাবএইডের সঙ্গে এক করে ফেলায় শপিংমলটির সার্বিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’
একের পর এক দোকান কিনে সেগুলো হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত করে মার্কেটটিকে ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, প্রথমে একটি-দুটি করে দোকান কেনে ল্যাবএইড। সেগুলোতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না খুলে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখে। এরপর সুযোগ বুঝে তাদের ভবনের সঙ্গে দোকানের দেয়াল ভেঙে যুক্ত করে নেয়। এতে মার্কেটের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দোকান কমে যাচ্ছে। ক্রেতারা আগের মতো মার্কেটে আসছেন না।
গত পাঁচ বছর ধরে নিচতলায় দোকান চালু করে ব্যবসা করছেন জোবায়ের হোসেন। বিভিন্ন জুয়েলারি বিক্রি করেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘মার্কেটের অনেকগুলো দোকান বন্ধ থাকায় ভেতরে অনেকটা অন্ধকার পরিবেশ। দোকান কমে যাওয়ায় প্রত্যাশিত সংখ্যক ক্রেতা আসছেন না।’ একই কথা বলেন তিন বছর ধরে এই মার্কেটে ব্যবসা করা নিখিল চন্দ্র দাস। তার দোকানের নাম ‘কোরি সিল্ক’। তিনি বলেন, ‘মার্কেটটা ক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একে একে দোকান বন্ধ হচ্ছে। ক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছেন। আমরা লসে আছি।’
সরেজমিনে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় পুরোদমে হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে। মার্কেটের অংশে স্থাপন করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বার, খাবারের কর্নার ও টয়লেট। এছাড়া ল্যাবএইডের কেনা মার্কেটের অন্য দোকানগুলোতে রয়েছে– ল্যাবএইড অ্যাগ্রো, ল্যাবএইড ক্যাফে স্টোর, ল্যাবএইড এমআরডি (মেডিসিন রেকর্ড ডিপার্টমেন্ট), ল্যাবএইড সেলস্ অ্যান্ড মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট। এসব দোকানের ভেতরে মার্কেটসংশ্লিষ্ট কিছু নেই। রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফাইল। আবার অধিকাংশই বন্ধ। তবে কাপড়ের একটি দোকান রয়েছে। যেটার নাম ল্যাবএইড ফ্যাশন অ্যান্ড ফিউশন। এসব দোকানের মধ্যে ল্যাবএইড এমআরডিতে পেছনের অংশের দেয়াল ভেঙে করিডোর বানানো হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে কলাপসিবল গেট।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ল্যাবএইডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা এ.এম. শামীম বলেন, ‘শপিংমলের চারটা ফ্লোর আমাদের। গত ১০ বছর ধরে সানাউল হক নিরু সভাপতি হয়ে আছেন। তিনি আমাদের ঢুকতে দেন না। আমাদের কাছে চাঁদা চান। আমাদের কাজ করতে দেন না। লোকজনকে মারধর করা হয়। আমাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করতে নানা অভিযোগ করা হচ্ছে। ’
দোকান কিনে মার্কেটে হাসপাতাল বানানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক না। আমাদের দোকানগুলো খুলতেই দেয় না। কন্টিনিউয়াস মামলা করছে তারা।’
মার্কেট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে চলামান বিবাদ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ধানমন্ডি জোনের এডিসি আব্দুল্লাহিল কাফি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কনকর্ড আর্কেডিয়া মার্কেটের বেশ কিছু দোকান কিনে নিয়েছে ল্যাবএইড। দুপক্ষের মধ্যে এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঝামেলা চলছে। গত ২১ জানুয়ারি সংঘর্ষের পর দুপক্ষই পাল্টাপাল্টি মামলা করেছে। ওই মামলার তদন্ত চলছে।’