৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং | ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:১৮

অটোরিকশাতেই হত্যা করা হয় ঝালমুড়ি বিক্রেতা আজাদকে

সারাদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঝালমুড়ি বিক্রির পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে তুরাগের কামারপাড়ায় ফিরতে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠেন আজাদ পাটোয়ারী। স্লুইস গেইট এলাকা অটোরিকশায় উঠার সময় ভেতরে বসা ছিল আরও দুজন। বাম পাশে বসেন আজাদ। কিন্তু কৌশলে তাকে মাঝখানে বসানো হয়। গাড়িটি নির্জন স্থানে পৌঁছানোর পর চালক মাথা চুলকিয়ে ইশারা করে। ইঙ্গিত পেয়ে বাকি দুই যাত্রী আজাদের পিঠে আঙ্গুল তাক করে বলে, যা আছে সব বের কর। আজাদ তার কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং অটোরিকশা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি। তাকে একজন শক্ত করে হাত ধরে রাখে। অপরজন আজাদের গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরে। এভাবে কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আজাদ। এরপর তার লাশটি খিলক্ষেত ফ্লাইওভারে উঠার পথে ডানপাশের রাস্তায় ফেলে চলে যায় সিএনজিতে করে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা।

গত ২৯ ডিসেম্বর রাতে এ ঘটনা ঘটে। একই কায়দায় হত্যাকাণ্ডের শিকারও হওয়া আরও তিন ব্যক্তির লাশ ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইওভারের কাছে পাওয়া গেছে। সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি মগবাজার ফ্লাইওভারে মিজানুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার পুলিশ। মিজানুর রহমান নিহতের ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন তার ভাই আরিফ হোসেন।

অটোরিকশায় একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ও হত্যার অভিযোগে তদন্তে নামে হাতিরঝিল থানা পুলিশ ও তেজগাঁও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গত ২৩ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে টঙ্গী থেকে নুরুল ইসলাম নামে এক অটোরিকশা চালককে গ্রেফতার করা হয়। এর একদিন পর ২৫ জানুয়ারি গাজীপুরা ও তুরাগ এলাকা থেকে আবদুল্লাহ বাবু ও জালাল নামে আরও দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

তিনজনকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান তেজগাঁও বিভাগের তদন্ত কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুক  বলেন, ‘নুরুল ইসলাম মূলত সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক। এর আড়ালে তার মূল পেশা ছিনতাই। সে নিজেসহ আরও আটজন মিলে গড়ে তুলেছিল অটোরিকশা-কেন্দ্রিক দুটি ভয়ংকর ‘ছিনতাই ও কিলিং’ গ্রুপ। রাত আটটার পর থেকে সকাল পর্যন্ত আশুলিয়া, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, গুলশান, ভাটারা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, রামপুরা, ৩০০ ফিট, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড এলাকায় সিএনজিতে যাত্রী উঠিয়ে ছিনতাই করে তারা।

হাফিজ আল ফারুক জানান, গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সে ও তার সহযোগীরা মিলে আজাদকে ছিনতাইয়ের পর হত্যা করেছে। আজাদসহ বাকি তিনটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও তারা জড়িত।

নুরুল ইসলাম ও বাকি দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও কয়েকজন সহযোগীর নাম বেরিয়ে আসে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের সহকারী কমিশনার মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম তিনজনকে গ্রেফতারের পর আমরা শাহীন, নাজমুল, গোলাম মোস্তফা জীবনসহ কয়েকজনের নাম জানতে পারি। এরপর তাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু হয়।’

তদন্ত কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, শাহীন ও নাজমুল যাত্রীবেশে পিছনে বসে ছিনতাই করত। আর গোলাম মোস্তফা সিএনজি মালিকের কাছ থেকে নিজে চালানোর কথা বলে নিয়ে আসত। এরপর ভাড়া ও ছিনতাইয়ের টাকার ভাগ দেওয়ার শর্তে নুরুল ইসলামসহ অন্যদের হাতে অটোরিকশাটি তুলে দিত। আর তা নিয়েই শহরব্যাপী ঘুরে ঘুরে ছিনতাই করত নুরুল ইসলাম ও তার চক্রের সদস্যরা।

এদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযানে নামেন তেজগাঁও থানা পুলিশের সদস্যরা। ২৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে তুরাগ থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় গোলাম মোস্তফা জীবনকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায়, নাজমুল ও শাহীন তার কাছ থেকে সিএনজি নিয়ে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে।

হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রশীদ জানান, খিলক্ষেতের ডুমিনি আহবপাড়া এলাকায় ওই দিন রাত পৌনে চারটার দিকে হাতিরঝিল থানা পুলিশের নিরাপত্তা চৌকির মুখোমুখি হওয়ামাত্র নাজমুল ও শাহীন সিএনজি থামিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নাজমুল ও শাহীন গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ছিনতাইকারীদের গুলিতে চার পুলিশ সদস্য আহত হন।

মামলার অন্যতম আসামি নূরুল ইসলামসহ চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসি আব্দুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘নুরুল ইসলাম, জালাল, আবদুল্লাহ বাবু ও গোলাম মোস্তফা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তারা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।’

এক মাস পর ঝালমুড়ি বিক্রেতার লাশ পেলেন স্ত্রী

এক মাস আগে ২৯ ডিসেম্বর সকাল এগারোটায় ঝালমুড়ি বানানোর সরঞ্জাম নিয়ে বের হন আজাদ পাটোয়ারী। রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে বাসায় ফেরার কথা থাকলেও তিনি আর ফিরেননি। জীবিত আজাদের সন্ধান না পাওয়া গেলেও তার মরদেহ খুঁজে পেয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। গত ২৯ জানুয়ারি তানিয়া আক্তার স্বামী আজাদের মরদেহ শনাক্ত করেন।

পুলিশ ও হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে আজাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এরপর জানাজা শেষে তাকে কামারপাড়ায় সরকারি কবরস্থানের সমাহিত করা হয়েছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অটোরিকশায় করে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি রয়েছেন। যার মরদেহ খিলক্ষেত ফ্লাইওভারের পাশে পাওয়া যায়।

অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের জন্য তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদারের নির্দেশে খিলক্ষেত থানা থেকে ওই ব্যক্তির ছবি সংগ্রহ করা হয়।  ২৭ জানুয়ারি তেজগাঁও বিভাগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে অজ্ঞাত সেই ব্যক্তির ছবিসহ একটি পোস্ট করা হয়। যা ২৯ জানুয়ারি নজরে আসে আজাদ যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেই বাড়ির মালিকের ছেলের। তিনি আজাদের ছবি তার স্ত্রী তানিয়াকে দেখান। তানিয়া পরে পুলিশের সহায়তায় হাসপাতালের ফ্রিজে রাখা স্বামীর মরদেহ শনাক্ত করেন।

এদিকে গত ২ ফেব্রুয়ারি আজাদের স্ত্রী তানিয়া ও তার সন্তানদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার।

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২০ ১:৪১ অপরাহ্ণ