২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরদার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যাকাণ্ড, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বাস্তবতায় জীবন বাঁচাতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে গত ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মামলা করে গাম্বিয়া। গত বছর ডিসেম্বরে ওই মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পক্ষে সাফাই গান সু চি। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে; বিশ্বপরিসরে সু চি মানবাধিকার হরণের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়েছিলেন যতটা না আদালতে লড়াই করার জন্য, তার থেকে বেশি নিজ দেশে তার জাতীয়তাবাদী গ্রহণযোগ্যতাকে ঝালিয়ে নিতে।
নিজ দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন সু চি। তাতে অবশ্য আদালত প্ররোচিত হননি। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ঠেকাতে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দিয়েছেন আইসিজে। সাবেক মার্কিন কংগ্রেস সদস্য এবং জাতিসংঘ দূত বিল রিচার্ডসন বলেন, ‘আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশের পর সু চি তার সমস্ত মান-সম্মান খুইয়েছেন। গণতন্ত্রের জন্য নোবেলজয়ী থেকে তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন একজন স্বৈরশাসকে, যে তার ক্ষমতা ধরে রাখতে সামরিক নিপীড়ন, গণহত্যা ও রোহিঙ্গা নিধনকে বৈধতা দেন।’
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় গণহত্যার আলামত পেলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সু চি’ও রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনও ইতিবাচক ভূমিকা নিতে সক্ষম হননি। বরং গণহত্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতেও কোনও উদ্যোগ নেননি তিনি, উল্টো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে থাকার দায় ঢাকার ওপর চাপিয়েছেন। সবমিলে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সুরক্ষায় তার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
সামরিক শাসনের মিয়ানমারে সু চির অহিংস আন্দোলন চূড়ান্ত সাফল্য পায় ২০১৫ সালে। ওই বছর তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায়। আশা করা হচ্ছিল এর মাধ্যমে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করবে। তবে বিপরীত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ক্রমশ পতনের পথে ধাবিত হতে থাকেন সু চি। পতনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো হওয়ার পর।
রোহিঙ্গা নিপীড়নের খবর সামনে আসতে শুরু করলে ১৯৮৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু সু চিকে এক খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘জনজীবনে আপনার উত্থান হওয়ার পর রোহিঙ্গা নিপীড়ন প্রশ্নে আমাদের উদ্বেগ প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু এখনও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বজায় রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন কেউ কেউ, আবার অনেকের কাছে তা ‘ধীর গতির গণহত্যা’। সম্প্রতি সেই সহিংসতা আরও বেড়েছে। ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে কোনও ব্যক্তি দেশ পরিচালনা করতে গেলে এ বিষয়গুলো তার কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ার কথা। এমন যদি হয় যে আপনার নীরবতা হলো মিয়ানমারের উচ্চ পদে আসীন হওয়ার রাজনৈতিক মূল্য চুকানো, তবে নিশ্চিতভাবে বলবো এ মূল্যটা খুব চড়া।”
জাতিসংঘ দূত বিল রিচার্ডসন বহুদিন সু চির প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। রাখাইন সংকট নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হতে পাঠানো সু চির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিক রোহিঙ্গা নিপীড়নের খবর প্রকাশের জেরে গ্রেফতার হলে তাদের মুক্তি দিতে সু চির প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তবে সেই পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান সু চি। মোহমুক্তি ঘটে রিচার্ডসনের। উপদেষ্টা বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
রিচার্ডসন সেই প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছিলাম একজন সংস্কারক ও সাবেক গণতন্ত্রপন্থী কীভাবে ক্ষমতাপ্রিয় ও সুরক্ষিত নেতায় পরিণত হচ্ছেন। তিনি সেনাবাহিনীর সাফাই গাওয়া একজন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন যাতে করে তিনি নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন এবং পুনর্নির্বাচিত হতে পারেন। তিনি স্বাভাবিকভাবেই কোনও ভিন্নমত সহ্য করতে পারছিলেন না, এমনকি আমার মতো তার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সমর্থকদেরও না।’
এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সু চির অবস্থানের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক বাস্তবতার। নিজ দলের বিশাল বিজয়ের পরও সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রশ্নে এখনও দেশের প্রকৃত শাসক সেনাবাহিনী। সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়ে সু চির মিত্র ছিল লবিং গ্রুপ বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে। তারা মনে করছে, সু চি রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন নিজেকে জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করে আসন্ন নির্বাচনে তার ভোট বাড়ানোর স্বার্থে।রোহিঙ্গা নিধনের প্রেক্ষাপটে একের পর এক সম্মাননা হারাতে থাকেন সু চি। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেন্ট হিউ’র পরিচালনা পর্ষদ কলেজের মূল ফটক থেকে সু চির প্রতিকৃতি নামিয়ে ফেলে। অক্টোবর মাসের শুরুতে অক্সফোর্ড সিটি কাউন্সিল সর্বসম্মতভাবে সু চির ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব অক্সফোর্ড পদক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে রাখাইনে রোহিঙ্গা মানবিক সংকটে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে অক্সফোর্ড কলেজ তাদের জুনিয়র কমন রুম থেকে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির নাম প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সেন্ট হিউ’স কলেজের শিক্ষার্থীরা কমন রুম থেকে সু চির নাম মুছে ফেলার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের আগস্টে এডিনবার্গ কর্তৃপক্ষের দেওয়া ‘ফ্রিডম অব সিটি’ সম্মাননা কেড়ে নেওয়া হয়। নভেম্বরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দেওয়া খেতাব হারান তিনি।