এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে নগরবাসীর মধ্যে। তারা বলছেন, পলিথিনের কারণে হরদম নগরীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। যখন-তখন বন্ধ হচ্ছে নালা-নর্দমা। তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এর মধ্যে নগরবাসীর সেবার জন্য ভোটে নেমে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজেরাই পরিবেশ দূষণের কারণ হচ্ছেন।
নগরী ঘুরে দেখা গেছে, পলিথিন মোড়ানো পোস্টারের জোয়ার বইছে রাজধানীজুড়ে। মেয়র পদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের সবার পোস্টার পলিথিনে মোড়ানো কিংবা লেমিনেটেড। কাউন্সিলর প্রাথীরাও পিছিয়ে নেই। প্রায় ৮৫ শতাংশ প্রার্থী লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহার করেছেন তাদের প্রচারণায়।
‘সংগত কারণে এখানে আমরা কারও নাম উল্লেখ করছি না। তবে লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের। পথে নানা কারণে বেশি পরিমাণে ছিঁড়ে পড়তেও দেখা গেছে তাদের পোস্টার। দড়িতে লাগানো পোস্টারের মালা গিয়ে পড়ছে রাস্তার পাশের ড্রেনে। বিএনপিদলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের লেমিনেটেড পোস্টারও দেখা গেছে অনেক জায়গায়।
নির্বাচনে ভোটারের দৃষ্টি আকর্ষণ ও প্রচারণার প্রধান অনুষঙ্গ পোস্টারের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। তবে এবার তা ভয়াল রূপে হাজির হয়েছে নগরীতে। বছর কয়েক আগেও পলিথিনে মোড়ানো পোস্টারের এমন সর্বপ্লাবী দৃশ্য দেখা যায়নি কোথাও। ফলে ভোটের পর অপ্রয়োজনীয় পোস্টার অপসারণ নিয়ে চিন্তিত সিটি করপোরেশনের বর্জ ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
নির্বাচনী আচরণবিধিতে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টারের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। পরিবেশ আইনেও অস্পষ্টতার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। মূলত এই সুযোগ নিয়ে প্রার্থীরা তাদের পোস্টার বৃষ্টি-কুয়াশা থেকে রক্ষার এই কৌশল নিয়েছেন। কিন্তু নগরবাসীর প্রশ্ন, তাই বলে পরিবেশের ক্ষতির দিকটি প্রার্থীরা দেখবেন না! নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য তারা নির্বাচিত হতে ভোটভিক্ষা চাইছেন দুয়ারে দুয়ারে। এটা তো স্ববিরোধিতা।
একই কথা বলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, পোস্টারে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ হওয়া বা না হওয়ার চেয়ে বড় বিষয় হলো এটি ক্ষতিকর। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পরিবেশ ভালো রাখবেন এ প্রত্যাশা সবার। কিন্তু তারা নিজেরাই যদি বিষয়টি না বোঝেন তাহলে পরিবেশ ভালো থাকবে কীভাবে?”
ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র পদে ছয়জন করে মোট ১২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ১৭২টি পদের বিপরীতে লড়ছেন ৭৪১ জন প্রার্থী। তাদের লাখ লাখ পোস্টার এখন নগরীর পরিবেশের প্রতি চোখ রাঙিয়ে ঝুলছে সর্বত্র। নগরে এখন মানুষের চেয়ে পোস্টারের সংখ্যা বেশি। কোথাও কোথাও অসাবধানী পথচারীর পায়ে-গায়ে জড়ায় পোস্টারের রশি।
নগরভিত্তিক সামাজিক সংগঠন ‘ঢাকাবাসী’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি শুকুর সালেক চিন্তিত এসব লেমিনেটেড পোস্টারের পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিয়ে। তিনি আশঙ্কা করছেন নগরের সর্বত্র ব্যবহৃত এসব পোস্টার নগরের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।
শুকুর সালেক বলেন, ‘আগে পোস্টার লাগানো হতো আঠা দিয়ে। এবার পোস্টার লেমিনেটেড বলে স্টাপ্লার পিন ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে এসব পোস্টার ছিঁড়ে-ছুটে পড়ছে। এই পোস্টারের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না হলে ঢাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখেড় পড়বে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের একটা দায়িত্ব রয়েছে। তারা নজর রাখবেন আশা করি।’
নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধিতে পোস্টারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘কাগজ, কাপড়, রেক্সিন, ডিজিটাল ডিসপ্লেবোর্ড বা ইলেকট্রনিকস মাধ্যমসহ অন্য যেকোনো মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত কোনো প্রচারপত্র, প্রচারচিত্র, বিজ্ঞাপনপত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র এবং যেকোনো ধরনের ব্যানার ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে।’
কমিশনের আচরণবিধিতে পলিথিন ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা না থাকায় ইসি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না বলে জানান নির্বাচন কমিশনায় রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের আচরণ বিধিমালায় পলিথিনের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইনে যদি থাকে তাহলে সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে।’
নির্বাচনী পোস্টারে ব্যবহৃত এসব পলিথিন নিষিদ্ধ পলিথিনের তালিকায় নেই বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট উইংয়ে উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
কিন্তু ১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬/ক ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার, মহাপরিচালকের পরামর্শ বা অন্য কোনভাবে যদি সন্তুষ্ট হয় যে, সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোন সামগ্রী বা অন্য যে কোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাহা হইলে, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, সমগ্র দেশে বা কোন নির্দিষ্ট এলাকায় এইরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করিবার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ঐ সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করিতে পারিবে এবং উক্ত নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বাধ্য থাকিবে।”
উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নির্বাচন শেষে এই পোস্টারের পলিথিনগুলো যেন পরিবেশগতভাবে বিনষ্ট করা হয়, সেদিকে আমাদের সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রয়েছে।’ প্রার্থী, নির্বাচন কমিশন, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা আশা করেন তিনি।
পলিথিনে মোড়ানো বিপুল পোস্টার নিয়ে চিন্তিত সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এসব পোস্টার সুষ্ঠুভাবে অপসারণ করা না হলে ম্যানহোল ও ড্রেনে আটকে পয়োনিষ্কাশনে বাধার কারণ হতে পারে।
একজন কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন শেষে প্রার্থীরা এসব পোস্টারের খবর রাখেন না। সিটি করপোরেশনের লোকজনকেই তা অপসারণ করতে হয়। তবে তারা এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুসরণ করবেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘পোস্টারে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে বরাবরই আমাদের একটি নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্বাচন শেষে তারা নির্দেশনা দিলে আমরা পোস্টার, ব্যানারগুলো খুলে ল্যান্ডফিলে নিয়ে যাবে।’
তার আগে পোস্টারে ব্যবহৃত পলিথিন গরিব মানুষ খুলে নেবে বলে জানান মো. আশরাফুল আলম। বলেন, ল্যান্ডফিল্ডে পলিথিন যত কম ফেলা যায় ততই ভালো।