শুক্রবার থেকে ইজতেমার মূল কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকে আম বয়ান শুরু হয়েছে। প্রায় সব জেলার জিম্মাদাররা টঙ্গীর ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। জেলা জিম্মাদারদের উদ্দেশে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে দিক-নির্দেশনামূলক আলোচনাও চলছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে মুসল্লিরা এসে ঢাকার কাকরাইল মসজিদসহ টঙ্গীর আশপাশের বিভিন্ন মসজিদে অবস্থান নিয়েছেন। শীত ও কনকনে হিমেল হাওয়াকে উপেক্ষা করেই মুসল্লিরা দলে দলে ভাগ হয়ে ইজতেমা ময়দানের তাদের স্ব স্ব খিত্তার দিকে আসছেন।>.
ইজতেমার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ইতোমধ্যেই মাঠ মুসল্লিদের পদচারণায় মুখরিত। বিভিন্ন জেলার কিশোর, যুবক, বয়োজ্যেষ্ঠ সব শ্রেণির মানুষ ইজতেমা মাঠে আসছেন। অনেকে ৪০ বা ১২০ দিন ইসলামের দাওয়াত শেষ করে ইজতেমায় শরিক হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ইজতেমা শেষে দেশ-বিদেশ ঘুরে ইসলামের দাওয়াত দিতে বেরিয়ে পড়বেন। সব ভেদাভেদ ভুলে ধনী-গরিব সবাই এখানে এক শামিয়ানার নিচে একসঙ্গে অবস্থান করছেন। মুসল্লিরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ব্যবহার্য দ্রব্য কাঁধে বহন করে মাঠে আসছেন।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে আসা মোহাম্মদ দুলাল মিয়া বলেন, ‘আজ সকালে এসেছি। আখেরি মোনাজাত শেষে মুরব্বিদের ঘোষণা এলে ইজতেমা স্থান ত্যাগ করবো। ইজতেমা মাঠের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আমরা কখনোই ভাবি না। আমাদের এখানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ ও রাসুল (সা.) সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। অর্জিত জ্ঞান দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।’
ইজতেমার প্রথম পর্বের গণমাধ্যম বিষয়ক সমন্বয়কারী মুফতী জহির ইবনে মুসলিম জানান, ‘তিন দিনের কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন জামাতের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। ময়দানজুড়ে বিশাল চটের শামিয়ানার নিচে বিভিন্ন জেলার মুসল্লিদের জন্য ৮৭টি খিত্তা নির্ধারণ করে খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার বিদেশি মেহমানের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা রেখে ময়দানের উত্তর-পশ্চিম দিকে আন্তর্জাতিক নিবাস নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জামাতবদ্ধ মুসল্লি ছাড়াও ব্যক্তিগত ও স্থানীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নেবেন।’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ জানান, বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০ লাখ মুসল্লির সমাগমকে সামনে রেখে প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি গ্যালন পানির ব্যবস্থা থাকছে। বাড়তি টয়লেট নির্মাণ ও পাকা টয়লেটগুলো ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এস এম তরিকুল ইসলাম জানান, বিশ্ব ইজতেমা চলাকালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মুসল্লিদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকবে। সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মুসল্লিদের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ মেডিক্যাল টিম। মাঠের আশপাশের খাবার দোকান ও আবাসিক হোটেলের মান ঠিক রাখতে ১২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছেন। সেনাবাহিনীর সহায়তায় তুরাগ নদীতে তৈরি করা হয়েছে ছয়টি ভাসমান সেতু।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে প্রথমবারের মতো আমি বিশ্ব ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের খেদমত করার সুযোগ পেয়েছি। দেশ-বিদেশ থেকে আসা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সব রকম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের সব দফতরকে নির্দেশ দিয়েছি। বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য সিটি করপোরেশন কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে। এজন্য দুই হাজার কর্মী মাঠে কাজ করছেন। ইজতেমার মুরব্বিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তাদের যে কোনও সমস্যা সমাধানে তৎপর রয়েছে সিটি কর্তৃপক্ষ।’
তিনি আরও জানান, সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ৮টি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ১৫টি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। মাঠে ব্লিচিং-পাউডার ও মশক নিধনে পর্যাপ্ত ওষুধ ছিটানোর কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়া ৭৫০টি বৈদ্যুতিক বাতি স্থাপন ও ধুলাবালি যাতে না ওঠে সেজন্য পানি ছিটানোর ব্যবস্থা থাকছে। ইজতেমা চলাকালে ময়দানে আগত মুসল্লিদের উচ্ছিষ্ট ফেলার জন্য ময়দানের চারপাশে রিংয়ের তৈরি পোর্টেবল ডাস্টবিন স্থাপন করা হচ্ছে। যাতে ময়লা-আর্বজনা যেখানে সেখানে না ফেলে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে পারে।
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় থাকছে কড়া নিরাপত্তা
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আনোয়ার হোসেন জানান, আগত লাখ লাখ মুসল্লির নিরাপত্তায় পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দাসহ যৌথ বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য পাঁচ স্তরে ভাগ হয়ে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে ১৪টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। থাকছে পুরো ময়দানজুড়ে সিসিটিভি, আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর। সব খিত্তা নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে ফেলা হবে। সার্বিক নিরাপত্তায় এবার ইজতেমায় সাড়ে আট হাজার পুলিশ সদস্য কাজ করবে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র চালু থাকবে।
র্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল সরওয়ার-বিন-কাশেম জানান, ‘প্রতি বছরের মতো বাড়তি পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মাঠের ভেতর ও বাইরে বিভক্ত হয়ে কাজ করবে। র্যাবের দুটি হেলিকপ্টার ইজতেমা মাঠের আকাশে টহল দেবে। র্যাবের পক্ষ থেকে ১০টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। নজরদারির জন্য মাঠের চারদিকে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।’
স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল জানান, ‘ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরব্বিদের সঙ্গে কথা বলে সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখছি। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় আসা দেশি-বিদেশি মেহমানদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দফতরের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।’