২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:২৮

ফুটবলে জাগরণের বছর শেষে হতাশা

আরেকটি বছর সমাপ্তির পথে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। এরপর উল্টে যাবে বর্ষপঞ্জিকার পাতা। দেয়ালের পুরোনো বর্ষপঞ্জিকা ফেলে টানানো হবে ২০২০ সালের বর্ষপঞ্জিকা। পাল্টে যাবে টেবিল ক্যালেন্ডার, মানিব্যাগে থাকা পকেট ক্যালেন্ডারও। পকেটের স্মার্ট ফোনে ভেসে আসবে নতুন আলোর ঝলকানি, জানাবে হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২০।

শেষ হওয়ার পথে থাকা বছরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি; দুইয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে দেশের ফুটবলে। ঘটনাবহুল বছরের বিভিন্ন স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে রাইজিংবিডি’র ক্রীড়া বিভাগ। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ তুলে ধরেছেন ক্রীড়া বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম।

ইংলিশ কোচ জেমি ডে’র ছোঁয়ায় যেন বদলে গেল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। ফিটনেসে গুরুত্ব দিয়ে ডে বাংলাদেশ দলের চেহারাই বদলে দিলেন। তার তত্ত্বাবধানে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৯টি ম্যাচ খেলে। তার মধ্যে জয় ৪টিতে। ড্র ৩টিতে। হার ২টিতে। তার তত্ত্বাবধানেই বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। আফগানিস্তান, কাতার ও ভারতের বিপক্ষে নিজেদের সামর্থের জানান দেয়।

যদিও বছরের শেষ দিকে নেপাল থেকে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরেছে জেমি ডে’র শিষ্যরা (অনূর্ধ্ব-২৩)। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ২০১৯ সালটি ছিল বাংলাদেশের ফুটবলে জাগরণের বছর। র‌্যাঙ্কিংয়েও হয়েছে উন্নতি। বছরের শুরুতে বাংলাদেশ ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ছিল ১৯২তম অবস্থানে। আর বছর শেষ করেছে ১৮৭তম অবস্থানে থেকে। মাঝে একবার ১৮২তেও উঠেছিল।

জাতীয় নারী ফুটবল দল খুব বেশি ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট খেলেনি। তবে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা ফুটবলের শিরোপা জিতেছে যৌথভাবে। সাফে অবশ্য সুবিধা করতে পারেনি। বিদায় নিয়েছিল সেমিফাইনাল থেকেই। তবে বয়সভিত্তিক দল ভালো করেছে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স-আপ হয়েছে টাইব্রেকারে হেরে। আর এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয়বারের মতো জায়গা করে নিয়ে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ড্র করে প্রথমবার পয়েন্ট অর্জন করে। ক্লাব ফুটবলে আবাহনী স্বপ্নযাত্রা করেছিল এএফসি ক্লাব কাপে। আর ঘরোয়া ফুটবলে বসুন্ধরা কিংসের উত্থান দেখেছে ফুটবলপ্রেমীরা।

ফিরে দেখা জাতীয় ফুটবল দলের পারফরম্যান্স:

কম্বোডিয়া ০ : ১ বাংলাদেশ

২০১৯ সালের মার্চে বাংলাদেশ প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে কম্বোডিয়ার বিপক্ষে। ওই ম্যাচে রবিউল হাসানের গোলে ভর করে দারুণ এক জয় পায় বাংলাদেশ। এই জয় বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাসের পারদ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।

লাওস ০ : ১ বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ০ : ০ লাওস

জুনে (৬ জুন) বাংলাদেশ খেলে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের প্রাক বাছাইপর্ব। এই বাছাইয়ে লাওসের বিপক্ষে বাংলাদেশ হোম অ্যান্ড অ্যাওয়েতে দুটি ম্যাচ খেলে। লাওসের বিপক্ষে হেরে গেলে বাংলাদেশের ফুটবল প্রায় দুই বছরের জন্য নির্বাসিত হতো আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে। কিন্তু তরুণ তুর্কি সেই রবিউল হাসানের গোলে লাওসের মাঠ থেকে ১-০ গোলের জয় নিয়ে দেশে ফেরেন জামাল ভুঁইয়া, সাদ উদ্দিনরা।

১১ জুন ফিরতি লেগে বাংলাদেশ ঘরের মাঠে লাওসের বিপক্ষে জয় পায়নি। করে গোলশূন্য ড্র। কিন্তু অ্যাওয়ে ম্যাচে জেতায় বাংলাদেশ পৌঁছে যায় বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাইয়ের মূলপর্বে।

বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব:

১৯৮৬ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে জায়গা করে নেওয়া বাংলাদেশ ড্রতে ‘ই’ গ্রুপে পড়ে। যেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক কাতার, ভারত, ওমান ও আফগানিস্তানের মতো শক্তিশালী দলকে।

আফগানিস্তান ১ : ০ বাংলাদেশ

সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে মাঠে নামে। প্রথম ম্যাচে নিরপেক্ষ ভেন্যু তাজিকিস্তানে ১০ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের মুখোমুখি হয় জেমি ডে’র শিষ্যরা। দারুণ খেলেও হার মানে ১-০ গোলে। বাংলাদেশ হারলেও তাদের পারফরম্যান্স মন জয় করে নেয় দেশের ফুটবলপ্রেমীদের।

বাংলাদেশ ৪ : ১ ভুটান

বাংলাদেশ ২ : ০ ভুটান

বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ভালো খেলেও হার মানার পেছনের কারণ ছিল প্রস্তুতি ম্যাচ না খেলা। তাইতো কাতারের বিপক্ষের ম্যাচের আগে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ জানায় ভুটানকে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে। ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম ম্যাচে নাবীব নেওয়াজ জীবনের জোড়া গোলে ভুটানকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। এরপর ৩ অক্টোবর পরের ম্যাচে ইয়াসিন খানের জোড়া গোলে বাংলাদেশ জয় তুলে নেয় ২-০ ব্যবধানে।

বাংলাদেশ ০ : ২ কাতার

ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে কাতারকে আতিথ্য দেয় বাংলাদেশ। ম্যাচের ২৮ মিনিট পর্যন্ত নিজেদের জাল অক্ষুন্ন রাখে এশিয়ার চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে। ২৯ মিনিটে প্রথম গোল হজম করে। এরপর ম্যাচের যোগ করা সময়ে (৯০+২) আরও একটি গোল হজম করে। শেষ পর্যন্ত ভালো খেলেও বাংলাদেশ হার মানে ২-০ গোলে।

ভারত ১ : ১ বাংলাদেশ

কাতারের বিপক্ষের ম্যাচের আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশ যায় ভারতে। ৩৪ বছর পর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলে সল্টলেকের যুব ভারতী স্টেডিয়ামে। ১৫ অক্টোবর ৬৩ হাজার দর্শকের সামনে বাংলাদেশ দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে। ৪২ মিনিটে সাদ উদ্দিন গোল করে স্তব্ধ করে দেন গর্জন তুলতে থাকা যুব ভারতী স্টেডিয়ামকে। ৮৮ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত পয়েন্ট ভাগাভাগি করে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।

ওমান ৪ : ১ বাংলাদেশ

১৪ নভেম্বর বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ২০১৯ সালের শেষ ম্যাচে মাঠে নামে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ ছিল ওমান। প্রথমার্ধে কোনো গোল হজম না করলেও খেই হারায় দ্বিতীয়ার্ধে। হেরে যায় ৪-১ গোলের ব্যবধানে।

এসএ গেমস ব্যর্থতা:

বাংলাদেশ দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়েরই বয়স কম। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসএ গেমসে অলিম্পিক দলের আদলে পুরো জাতীয় দলই নেপালে পাঠায়। কোচ হিসেবে থাকেন যথারীতি জেমি ডে। তাতে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছিল ২০১০ সালের পর এসএ গেমস ফুটবলে সোনা জয়ের। কিন্তু হিমালয়ের দেশে জ্বলে উঠতে পারেননি জামাল-সাদরা। ক্লাব ফুটবলের টাকার হাতছানি সেরা পারফরম্যান্স করতে দেয়নি বাংলাদেশের ফুটবলারদের। সেটার খেসারত দিতে হয়েছে ভুটান ও নেপালের কাছে হেরে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় ও মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র করে ব্রোঞ্জ জিতে দেশে ফেরে বাংলাদেশ।

নারী ফুটবল:

মার্চে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে গ্রুপপর্বে নেপালের কাছে ৩-০ ব্যবধানে হার মানে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। পরে ভুটানকে হারিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয়। সেখানে ভারতের কাছে উড়ে যায় ৪-০ গোলে। তাতে শেষ চারেই থামে বাংলাদেশের যাত্রা।

মে মাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ফাইনালে ওঠে। যদিও ফণীর কারণে ফাইনাল ম্যাচটি মাঠে গড়াতে পারেনি। তাই বাংলাদেশ ও লাওস নারী দলকে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়।

এছাড়া এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয়বারের মতো জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। সেখানে প্রথম ম্যাচে থাইল্যান্ডের কাছে হেরে যায়। এরপর জাপানের কাছে হার মানে বড় ব্যবধানে। কিন্তু শেষ ম্যাচে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে ২-২ গোলে রুখে দিয়ে প্রথমবারের মতো এএফসির কোনো টুর্নামেন্টে পয়েন্ট অর্জন করে।

অক্টোবরে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকার নামক ভাগ্য পরীক্ষায় ৫-৩ ব্যবধানে হেরে রানার্স-আপ হয়।

ক্লাব ফুটবল:

এএফসি ক্লাব কাপে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা সব দলকে হারিয়ে ঢাকা আবাহনী লিমিটেড প্রথমবারের মতো পৌঁছে যায় নকআউট পর্বে। ইন্টার জোনাল সেমিফাইনালে তারা পায় উত্তর কোরিয়ার শক্তিশালী ক্লাব এপ্রিল-২৫ কে। ঘরের মাঠে তাদের ৪-৩ গোলে হারিয়ে রূপকথার জন্ম দেয়। অবশ্য ফিরতি লেগে পিয়ংইয়ংয়ে ২-০ গোলে হেরে থামে তাদের স্বপ্নযাত্রা।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্দান্ত খেললেও ঘরোয়া ফুটবলে আবাহনী শিরোপা হাতছাড়া করে। তাদের হটিয়ে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে নেয় বসুন্ধরা কিংস। ক্লাব ফুটবলে নতুন পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের জানান দেয় তারা।

প্রকাশ :ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯ ৫:৫১ অপরাহ্ণ