সারাদেশে আগুনের ঘটনা এবং এসব ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলছে। এবছর বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছে ২ হাজার ১৩৮ জন। আহত হয়েছে ১৪ হাজার ৯৩২ জন। অথচ ২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সারাদেশে আগুনের ঘটনায় মারা গেছে মোট একহাজার ৪৯০ জন। অর্থাৎ চলতি বছরে আগুনে মৃতের সংখ্যা গত ১০ বছরের দ্বিগুণ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এতথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগুনের ঘটনা এভাবে বাড়ার পরও জনসচেতনতা বাড়েনি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন—ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশন আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবনসহ কল-কারখানাগুলোতে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিতে সঠিক নজরদারি করতে পারছে না, বা করছে না। আর এ কারণে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েই চলছে।
জানা গেছে, দেশের বহুতল ভবন ও কল-কারখানাসহ বাণিজ্যিক ভবনগুলোর প্রায় ৯০ ভাগেই অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ ভবন পুরনো, তাই বর্তমানে সেগুলোতে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সংযোজন করাও কঠিন। তাছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলেও আগুনের ঘটনা বাড়ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সারাদেশে দেড় লাখ আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় একহাজার ৪৯০ জনের মৃত্যু এবং ৬ হাজার ৯৪১ জন দগ্ধ হয়েছেন। তবে শুধু ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ১৩৮ জন। দগ্ধ হন ১৪ হাজার ৯৩২ জন। এবছর আগুনের ঘটনায় ২০৩ কোটি ৯২ লাখ ৭৪ হাজার ৩১৫ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য বলছে, আগুনের ঘটনায় ২০০৯ সালে মারা যান ১১৮ জন, আহত হন ১ হাজার ৮৭ জন; ২০১০ সালে মৃত্যু ২৭১ জন, আহত ৭১৯ জন; ২০১১ সালে মৃত্যু ৩৬৫ জন, আহত ১ হাজার ৩৮৫ জন; ২০১২ সালে মৃত্যু ২১০ জন, আহত ৭৫৯ জন; ২০১৩ সালে মৃত্যু ১৬১ জন, আহত ১ হাজার ৩৮৫ জন; ২০১৪ সালে মৃত্যু ৭০ জন, আহত ২১০ জন; ২০১৫ সালে মৃত্যু ৬৮ জন, আহত ২১৬ জন; ২০১৬ সালে মৃত্যু ৫২ জন, আহত ২৪৭ জন; ২০১৭ সালে মৃত্যু ৪৫ জন, আহত ২৬৯ জন এবং ২০১৮ সালে মৃত্যু হয়েছে ১৩০ জনের এবং আহত হয়েছেন ৬৬৪ জন।
দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতেই ৩ হাজার ১৭৭টি আগুনের ঘটনায় মারা গেছেন ১৩০ জন ও আহত হয়েছেন এক হাজার ৭১ জন। ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ৪৪টি আগুনে ঘটনায় মারা যান ২৭৪ জন, আহত হন ১ হাজার ৩৭০ জন। মার্চে ২ হাজার ৯৩৮টি আগুনের ঘটনায় মৃত্যু ১১২ জন, আহত ১ হাজার ১৪৭ জন। এপ্রিলে ২ হাজার ৬৪২টি আগুনের ঘটনায় মৃত্যু ১৭৭ জন, আহত ১ হাজার ৪০০ জন। মে মাসে ১ হাজার ৯২১টি ঘটনায় মৃত্যু ১০৬ জন, আহত ১ হাজার ৯৯ জন। জুনে ১ হাজার ৫১৭টি আগুনের ঘটনায় মৃত্যু ১৯৬ জন, আহত ১ হাজার ৭৩২ জন। জুলাইয়ে ১ হাজার ৩৪১টি ঘটনায় মৃত্যু ২৪৯ জন, আহত ১ হাজার ২৭৬ জন। আগস্টে ১ হাজার ৩৫৮টি আগুনের ঘটনায় মৃত্যু ২৫৩ জন, আহত ১ হাজার ৯৯৮ জন। সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৪৬৭টি আগুনের ঘটনায় মৃত্যু ২০৬ জন, আহত ১ হাজার ৩৯৫ জন। অক্টোবরে ১ হাজার ৩২৪টি আগুনের ঘটনায় মৃত্যু ১৭৩ জন, আহত ১ হাজার ২৪৩ জন এবং নভেম্বরে ১ হাজার ৫৫৪টি আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৬২ জনের ও আহত হন এক হাজার একজন।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দগ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। আর এবছরের আগস্টে আগুনে দগ্ধ আহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অন্য বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে অগ্নিদুর্ঘটনা অনেক বেশি ছিল। প্রাণহানিও বেশি হয়েছে। বিশেষ করে চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার, কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানা এবং গাজীপুরের ফ্যান কারখানায় হতাহত বেশি হয়েছে।’
জনসচেতনতা আগের তুলনায় বেড়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আগুনের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বহুতল ভবনগুলোতে মহড়া দেওয়া, পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় ও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সেফটির বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। কিন্তু, পুরনো ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নতুন করে স্থাপন করা ব্যয়বহুল এবং কঠিন বিষয়। আমাদের সবদিকেই স্বল্পতা রয়েছে।’
২০১৯ সালের উল্লেখযোগ্য আগুনের ঘটনা
২০১৯ সালে বড় ধরনের বেশ কয়েকটি আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে হাজার হাজার মানুষ হতাহতের পাশাপাশি ঘরবাড়ি ও সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। জনমনে এসব ঘটনা এখনও দাগ কেটে রয়েছে।
রাজধানীর চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লেগেছিল। ওই আগুনে নারী ও শিশুসহ ৭১ জন পুড়ে মারা যান। অনেকেরই পরিচয় জানতে হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে। ওই ঘটনার তদন্ত
আজও শেষ হয়নি। ঘটনার পর থেকে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ওই এলাকার কেমিক্যাল গুদাম অপসারণে অভিযান শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এসব গুদাম সরিয়ে কেরানীগঞ্জে নির্মাণাধীন কেমিক্যাল পল্লিতে স্থানান্তরের কথা থাকলেও এখনও বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি।
বনানীর এফআর টাওয়ার ট্র্যাজেডি
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীতে ২৩তলা এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে ২৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বহুতল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ব্যানার ঝুলিয়ে দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তবে এখনও বেশির ভাগ ভবনেই কোনও ফায়ার সেফটির ব্যবস্থা করা হয়নি।
কেরানীগঞ্জে প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় আগুন
কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লাস্টিকের কারখানা। বিশাল জমির ওপর গড়ে ওঠা এই কারখানায় প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম প্লেট ও কাপ তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন অন্তত দেড় শতাধিক শ্রমিক। গত ১১ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে চারটার দিকে কারখানার গ্যাস চেম্বারে লিকেজ থেকে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ভয়াবহ এই আগুনে ঘটনাস্থলেই মাহবুব নামে একজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া, কারখানার দগ্ধ ৩১ জন শ্রমিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ও শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। পরে হাসপাতালে ২১ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর থেকে কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম পলাতক রয়েছেন।
গাজীপুরে ফ্যান কারখানায় আগুন
গত ১৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে গাজীপুর সদরের কেশোরিতা এলাকায় লাক্সারি ফ্যান কোম্পানি লিমিটেডের কারখানায় আগুন লাগে। এ ঘটনায় কারখানার ১০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন ১৫ জন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মদ খান বলেন, ‘কোনও ঘটনা ঘটার পর দেশের মানুষ সচেতন হয়। এর আগে সচেতনতা আসে না। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা শুধু ফায়ার সার্ভিসের কাজ নয়, নিজ উদ্যোগে সবাইকে এ কাজ করতে হবে। যেকোনও ভবন নির্মাণে ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এ ব্যাপারে বেশির ভাগ মানুষ উদাসীন।’
দেশের মানুষ এখনও অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন হচ্ছে। বারবার বলার পর দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে অন্য সেক্টর যেমন— কল-কারখানা, বাসা-বাড়ি, বাণিজ্যিকভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খুবই নগন্য। এটাকে আরও উন্নতি করতে হবে। সেইসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। সরকারের অন্য সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মনে করি।’