৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং | ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১:২৩

ধারে চলছে সরকার

প্রধান আর্থিক জোগানদাতা রাজস্ব খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে না সরকার। আবার দেশের বাইরে থেকেও আগের মতো ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সরকারের খরচ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে সরকারকে। এই ঋণের টাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ছয় মাস না যেতেই এই অর্থবছরের পুরো টাকাটাই নিয়ে ফেলেছে সরকার। এতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ব্যাংক খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যেও। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন বছরে এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে। তাদের মতে, সামনের দিনগুলোতে আরও খারাপ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। অর্থনীতিতে একটা বড় ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে। ব্যাংকের টাকা উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে বেশি যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর  বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা উৎপাদনশীল খাতে গেলে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে কমছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হচ্ছে। অন্যদিকে রাজস্ব আয় না বাড়ার ফলে সরকার ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা দিচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই সরকার ৪৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা ধার হিসেবে নিয়েছে। এই অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের ধারের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের টাকার টান পড়ে বেশি। কিন্তু এবার অর্থবছরের শুরুতেই টাকার টান পড়েছে। ফলে প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক থেকে টার্গেটের প্রায় সমান ধার নিয়ে ফেলেছে সরকার।

এদিকে  জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের প্রধান তিন খাতেই আদায় কমেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর এমএ তসলিম বলেন, ‘সরকার রাজস্ব খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত হারে টাকা পাচ্ছে না। আবার বিদেশ থেকেও আগের মতো ঋণ আসছে না। ফলে সরকার বাধ্য হয়েই ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি ধার করার রেকর্ডটি ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরের। ওই অর্থবছরে ধার নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। অথচ এই অর্থবছরের পাঁচ মাসেই পুরো অর্থবছরের টাকা নেওয়া শেষ করেছে সরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বেসরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা যে পরিমাণ ঋণ পাচ্ছে, সরকার ঋণ পাচ্ছে তার চেয়েও বেশি। গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের কাছে পাবে ১ লাখ ১০ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাবে ৪১ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত (সাড়ে ৫ মাসে) সরকার ব্যাংক খাত থেকে টাকা ধার নিয়েছে ৪৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ৭ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা; আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিয়েছে ৩৬ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।

এভাবে চলতে থাকলে বেসরকারি খাত চাহিদামতো ঋণ পাবে না বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি উল্লেখ করেন, সরকারের টাকা ধার নেওয়ার প্রবণতা বাড়লে কর্মসংস্থানের বাধা সৃষ্টিসহ জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপও বেড়ে যাবে। তিনি মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে রাজস্ব আহরণে সরকারের মনোযোগ দেওয়া জরুরি। তার মতে, উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার চেয়ে ব্যাংক থেকে নেওয়া মন্দের ভালো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবরে এনবিআরের রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ২২০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সরকারের ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে এই অর্থবছরে এনবিআরকে সার্বিকভাবে প্রায় ৪৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। অথচ চার মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ শতাংশের কিছু বেশি। এই সময়ে আয়কর, শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট—কোনও খাতেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। যদিও চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করার টার্গেট দেওয়া আছে।

এদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ২৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সঞ্চয়পত্র কেনায় নিয়মকানুন কড়াকড়ি করায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে কেবল ৫ হাজার ৫২১ কোটি টাকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ধার করার কথা সরকারের। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়ার কথা ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা রয়েছে।

এদিকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ায় আশানুরূপ ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। গত কয়েক মাস ধরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিক কমছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের হার কমেছে প্রায় দশমিক ৬২ শতাংশ। অক্টোবরে ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ ছিল ব্যাংক ঋণের হার। এই হার গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ হয়েছে। যা আগের মাস, সেপ্টেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ’ এর চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সরকার যেভাবে ঋণ নিচ্ছে তাতে বেসরকারি খাত কিছুটা বাধাগ্রস্ত তো হবেই। চলমান প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, আগামীতে সরকারের ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে।’ এতে ব্যাংক খাতে কিছুটা প্রভাব পড়বে বলেও মনে করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টার্গেটের চেয়ে এখন কিছুটা ঘাটতি থাকলেও বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে এনবিআর। ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সব শহরের বাড়িওয়ালারা যাতে সরকারকে ট্যাক্স দেয়, সেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরধারী (টিআইএন) সবাই যাতে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন, সেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করা যায়, সবকিছু ঠিক থাকলে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হলে সরকারের ব্যাংক ঋণও কমে আসবে।’

প্রকাশ :ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯ ৫:২০ অপরাহ্ণ