লন্ডনের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অভিবাসী বাংলাদেশির বসবাস বাঙালিপাড়া নামে পরিচিত টাওয়ার হ্যামলেটসে। সেখানকার কাউন্সিল আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাসহ ১০টি কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিসের জন্য আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বাজেট বরাদ্দ বন্ধ হয়ে গেলে সেখানকার প্রায় অর্ধশতাধিক আফটার স্কুলের বাংলা শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কাউন্সিলের তরফ থেকে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে তারা।
টাওয়ার হ্যামলেটসে কমিউনিটি ল্যাংগুয়েজ সার্ভিসের মাধ্যমে ১৯৮২ সাল থেকে বিনামূল্যে শিশুদের মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা, চাইনিজ, মেরিডিয়ান, রাশিয়ান, লিথুনিয়া, আরবি এবং সোমালিয়ান ভাষা শেখার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বাঙালি শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা ভাষা পড়ার সুযোগ পায়। অতিরিক্ত ভাষা হিসেবে বাংলা বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে শত শত শিক্ষার্থী জিসিএসই ও এ-লেভেল পরীক্ষায় ভালো করেছে। নতুন এক সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে গত ৩৭ বছর ধরে চলে আসা সেই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে হাজার হাজার বাংলাভাষী শিক্ষার্থীদের। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যয় সংকোচনের নামে কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিসের জন্য আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হলে বাংলায় পাঠদান বন্ধ হয়ে যাবে।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন ইউকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, লেবার দলীয় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর অত্যন্ত সফল একটি বিধান ‘কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিস’ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১৮ই ডিসেম্বর কাউন্সিলের ক্যাবিনেট সভায় মেয়র জন বিগস্-এর নেতৃত্বে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০১৯ সালের শুরুর দিকে একবার ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিস বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন বাংলাদেশি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন এর নেতৃত্বে পুরো কমিউনিটি সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে কাউন্সিল পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফেব্রুয়ারিতে কাউন্সিলের পূর্ণ ক্যাবিনেট সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সম্পূর্ণ সার্বিক পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের মধ্য দিয়েই এই সার্ভিসের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে। তবে তা হয়নি। বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে গত ১৮ ডিসেম্বর মালবারি এলাকায় বাজেট কর্তনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। আর সংগঠনের সভাপতি আবু হোসেন ও প্যারেন্টস একইদিনে ক্যাবিনেট সভায় এই সার্ভিস বন্ধ না করার পক্ষে অবস্থান নেন। তবে মেয়র জন বিগস্ সার্ভিসটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন।
কমিউনিটি সার্ভিসের আওতায় যেসব শিক্ষক ও ব্যবস্থাপক কাজ করেন, নতুন গৃহীত সিদ্ধান্তের কারণে তাদের সবারই চাকুরিচ্যুত হবেন। কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিস নামে আর কোনও বিধান কাউন্সিলে থাকবে না। বাংলা অধ্যয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে প্রায় ১৫০০ শিক্ষার্থী। বাংলাদেশি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন ইউকে সমগ্র কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠন, অভিভাবক, শিক্ষক, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমসহ সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য গত ২০ ডিসেম্বর এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। এই প্রতিবাদ সভায় বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে মোট কাউন্সিলর ৪৫ জন। এর মধ্যে লেবার পার্টির কাউন্সিলর ৪১ জন। ৪১ জনের মধ্যে ২২ জিই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। শনিবার রাতে এদের মধ্যে অন্তত ৬ জনের সঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তারা কেউই নাম প্রকাশ করে এ ব্যাপারে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলর ও বাসিন্দা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হলেও কেন বাংলা ভাষায় পাঠদান বন্ধ হচ্ছে, এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দলের অনুমতি ছাড়া এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তারা কথা বলতে অপারগ।
কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমেদ বলেছেন, কমিউনিটি ল্যাংগুয়েজ সার্ভিস বন্ধের বিষয়টি স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বার্থবিরোধী এবং জনবিরোধী একটি পরিকল্পনা।