২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:৪৮

ক্রাইম পেট্রোল দেখে শিশু হত্যাচেষ্টা, আটক ৩ কিশোর

পাবনা প্রতিনিধি : বন্ধুদের কাছে চাকাওয়ালা জুতো (স্কিডিং কেড্স) বিক্রির আড়াই হাজার টাকা চাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ইয়াসিন আরাফাত (১২) নামের এক শিশুকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তিন কিশোরের বিরুদ্ধে।

ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রোল দেখে এ হত্যাচেষ্টার ছক সাজিয়েছিল তারা। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের এমনই লোমহর্ষক তথ্য দিয়েছে আটক তিন কিশোর। আর মৃত ভেবে ফেলে রাখার দীর্ঘ প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর রক্তাক্ত মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকা শিশু আরাফাতকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনায় জড়িত অভিযোগে আটককৃতরা পাবনার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

এর আগে রোববার (১৫ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার গড়গড়ি গ্রামে ঘটে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা।

আটককৃতরা হল- রাফি, রাফিন ও প্রিন্স। তারা বাঁশেরবাদা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।

জানা গেছে, গড়গড়ি গ্রামের আকমল হোসেন মল্লিকের তিন মেয়ের পর আদরের একমাত্র ছেলে সন্তান ১২ বছরের ইয়াসিন আরাফাত। আওতাপাড়া সানফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্ডেনের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সে।

রোববার সকাল ৮টার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলার পর আর বাড়িতে ফেরেনি সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে রাত ১০টার দিকে থানা পুলিশকে জানান বাবা আকমল হোসেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে অভিযানে নামে ঈশ্বরদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) অরবিন্দ সরকার, এসআই অসিত কুমার বসাক, এসআই শরিফুল ইসলামসহ সঙ্গীয় ফোর্স। রাত ১১টা ১০মিনিটে প্রথমেই আরাফাতের এক বন্ধু রাফিকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা।

এরপর তার আরো দুবন্ধু রাফিন ও প্রিন্সকে ডেকে নিয়ে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এক পর্যায়ে তারা আরাফাতকে হত্যার কথা স্বীকার করে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাত দেড়টার দিকে বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে এক আখের ক্ষেতের মধ্যে থেকে শিশু আরাফাতকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে রাজশাহী মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আর আটক তিনজনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

যেভাবে হয় আরাফাত হত্যার পরিকল্পনা : শিশু আরাফাত তার চাকাযুক্ত কেডস কয়েকমাস আগে তার বন্ধু রাফির কাছে আড়াই হাজার টাকায় বাকীতে বিক্রি করে। কিন্তু সেই টাকা না দেয়ায় মাঝেমধ্যে আরাফাত টাকা চাইতে থাকে রাফির কাছে। কিন্তু রাফি টাকা দিতে পারে না। রাফির সখের অনেকগুলো কবুতর আছে। শেষে আরাফাত বলেছিল যে, ‘রাফি তুই টাকা দিতে পারছিস না, তুই আমাকে কবুতর দে।’ কিন্তু রাফি কবুতর দিতে রাজি হয় না। এদিকে আরাফাত টাকার জন্য চাপ দিতেই থাকে। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার মাঝে রাফি তার অপর দুই বন্ধু রাফিন ও প্রিন্সকে নিয়ে তৈরি করে আরাফাতকে হত্যার পরিকল্পনা।

কারণ, আরাফাতকে শেষ করতে পারলে আর টাকা দিতে হবে না। পরিকল্পনা করে কৌশলে গ্রামের এক আখ ক্ষেতে নিয়ে আরাফাতকে হত্যা করার। এর মধ্যে রাফি তাদের বাড়িতে থাকা অনুমান এক ফুট দৈর্ঘ্যর লোহার রড বাজার করা ব্যাগে নিয়ে আগেই ঘটনাস্থলে (আখ ক্ষেতে) গিয়ে রেখে আসে।

এরপর ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে কৌশলে আরাফাতকে আখের ক্ষেতে ডেকে নিয়ে যায় রাফি, রাফিন ও প্রিন্স। আরাফাতের থেকে রাফি খাটো হওয়ায় সে তাকে মাথায় আঘাত করতে সুযোগ পারছিলনা। তাই রাফি আরাফাতকে বলে, আখের গোড়ার দিকে যে নতুন কুশি বের হইছে তুই সেগুলো বসে থেকে ভেঙে দে। বাড়িতে নিয়ে লাগালে সেগুলো আবার গাছ হবে। আরাফাত রাফি’র কথা মতো তাই করতে গেলে আখের গাছের গোড়ায় বসলে আরাফাতের পিছন হতে আগে থেকে রাখা সেই রড দিয়ে ক্রমাগত মারতে থাকে রাফি। রক্তাক্ত অবস্থায় আরাফাত মাটিতে পড়ে গেলে সাড়া শব্দ না পেয়ে মৃত ভেবে ফেলে রেখে তারা চলে যায়।

আঘাত করা লোহার রড বাড়িতে যাওয়ার সময় রাফি একটি পুকুরে ফেলে দেয়। অবশেষে রাফি পুলিশকে জানায়, সে ভারতীয় ক্রাইম পেট্রোল সিরিয়াল দেখে এই পরিকল্পনা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছে।

এ বিষয়ে অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ঈশ্বরদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) অরবিন্দ সরকার বলেন, শীতের মধ্যে রাত দেড়টায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে আখ ক্ষেতের মধ্যে টর্চলাইটের আলোতে এক শিশুকে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কাজ ছিল। তারপর অনেক খুঁজে যখন আমরা আরাফাতের সন্ধান পাই, তখন সবাই ভেবেছিলাম হয়তো সে মারা গেছে।

কারণ শিশু আরাফাতের মাথায় অনেকগুলো আঘাত, মাথার মাংসগুলো বেড়িয়ে আসছে, বাম কান অধিকাংশ অংশ কাটা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার কাছে গিয়ে পালস দেখি সে বেঁচে আছে। মুখ থেকে খুব আস্তে ‘আব্বু আমাকে বাঁচাও’ শব্দ বের হচ্ছে। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এভাবে আঘাত করার দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা পরও একটা শিশু কিভাবে বেঁচেছিল এখনও ভাবতে অবাক লাগে।

আরাফাতের বাবা আকমল হোসেন মল্লিক বলেন, তার ছেলের খেলার সাথীরাই যে তাকে এভাবে হত্যার চেষ্টা করবে সেটা মেনে নিতে পারছেন না তিনি। তারপরও এমন নিষ্ঠুর ঘটনার বিচার দাবি করেন তিনি। কারণ এমন ঘটনার বিচার না হলে পরবর্তীতে এই কিশোররা আরও বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

রাজশাহী মেডিক‌্যালের নিউরো সার্জারি বিভাগের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে আরাফাতের। সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক ডা. আ ফ ম মোমতাজুল হক গণমাধ্যমকে জানান, রডের উপর্যুপুরি আঘাতে মাথার একটা অংশে খুলির হাড় ভেঙে মগজে চাপ দিচ্ছে। ভালো হতে দ্রুত অপারেশন প্রয়োজন।

ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাহাউদ্দিন ফারুকী জানান, ঘটনায় জড়িত অভিযোগে আটককৃতরা মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকেলে পাবনার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এর আগে আরাফাতের চাচা আবু তাহের মল্লিক বাদি হয়ে আটক তিনজনকে আসামি করে ঈশ্বরদী থানায় মামলা দায়ের করেন।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) শামীমা আক্তার বলেন, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। শিশুরা ক্রাইম পেট্রোল দেখে হত্যার মতো কাজে উৎসাহিত হচ্ছে, এটা খুবই আতঙ্কের বিষয়। টেলিভিশন দেখা খারাপ না। তবে সেখান থেকে ভালো জিনিসগুলো গ্রহণ করতে হবে। পরিবারকেও তাদের সন্তান সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।

প্রকাশ :ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯ ১:৫২ অপরাহ্ণ