রোহিঙ্গাদের কারণে প্রধান ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ওই মামলায় সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও গাম্বিয়াকে লজিস্টিক সহায়তা দেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদুল হক এরই মধ্যে হেগে রয়েছেন। আর সচিব (দ্বিপক্ষীয়) মাসুদ বিন মোমেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকেও একটি প্রতিনিধিদল গেছে।
এই প্রতিনিধিদলে মিয়ানমারে বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাই-কমিশনার এম সুফিউর রহমান, ইরানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত গৌসুল আজম সরকারসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক মহাপরিচালক ও পরিচালক রয়েছেন। এ ছাড়া একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও গণহত্যাবিষয়ক একজন গবেষকও রয়েছেন। আরও রয়েছেন তিনজন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ।
জাতিসংঘের অধীনে দুই ধরনের আন্তর্জাতিক আদালত আছে। তার একটি আইসিজে। এখানেই গাম্বিয়ার মামলার তিন দিনের শুনানিতে জাতিসংঘ নিযুক্ত ১৬ জন বিচারকের প্যানেল উভয়পক্ষের আইনজীবীদের প্রশ্ন করবেন। আদালত পরিপূর্ণ শুনানির আগে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী আদেশ দিতে পারেন।
শুনানি শেষে মামলাটি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে কিংবা জাতিসংঘের এ আদালত কী সিদ্ধান্ত দেয় বাংলাদেশ সেদিকে তীক্ষè নজর রাখছে। এই মামলায় মিয়ানমারের অপরাধী হিসেবে চিহিৃত হবে বলেই প্রত্যাশা বাংলাদেশের। আর অপরাধের জন্য মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীকে বড় ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে।
এই লক্ষ্যে পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলও হেগে পৌঁছেছে। তবে ওই দলে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিচারিক মামলার শুনানির অভিজ্ঞতা আছে এমন কোনো সদস্য না থাকায় প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার। ২০১৭ সালে বড় আকারের কাঠামোবদ্ধ নির্যাতন চালিয়ে দেশটি রাখাইন থেকে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৮ লাখেরও বেশি বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। এ নিয়ে জাতিসংঘ মিয়ানমারের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যার অভিযোগ করে আসছে। তবে এই প্রথম এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে মিয়ানমারকে।
গত ১১ নভেম্বর গাম্বিয়া ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থন নিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে মামলাটি করে। মিয়ানমার ও গাম্বিয়া দুই দেশই গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। এই সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ আইসিজের কোনো নির্দেশনা অমান্য করে চলতে পারে না। তাই এই মামলাটি বিপাকে ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৈশি^ক কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে আইসিজেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আদালত বলে বিবেচনা করা হয়।
আইসিজের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, গাম্বিয়ার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে মামলাটির শুনানি শুরু হবে। এরপর আত্মপক্ষ সমর্থন করে ১১ই ডিসেম্বর বক্তব্য উপস্থাপন করবে মামলার বিবাদি মিয়ানমার। আর ১২ ডিসেম্বর হবে যুক্তিতর্ক। প্রথমে অংশ নেবে গাম্বিয়া। পরে মিয়ানমার তা খণ্ডনের সুযোগ পাবে। মিয়ানমারের পক্ষে আদালতে লড়বেন দেশটির অং সান সু চি। এরই মধ্যে সু চি মিয়ানমারের ঘনিষ্ট মিত্র চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন।
এদিকে হেগে মামলার বিরুদ্ধে বেশ কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করেছে দেশটির কিছু মানুষ। সবশেষ গত শনিবার রাজধানী নেপিদোতে সু চির সমর্থনে মিছিল হয়েছে। বৌদ্ধ মন্দিরমন্দিরগুলোতে মামলার সাফল্য কামনায় প্রার্থনা অনুষ্ঠানে হাজির হয় বিপুলসংখ্যক মানুষ। আইসিজেতে মামলার শুনানিকালেও এ ধরনের কর্মসূচি পালিত হবে বলে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাওয়াদ্দীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-ধর্ষণসহ কাঠামোবদ্ধ নিপীড়ন শুরু করলে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঠাঁই নেয়। তার আগে থেকে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে মোট ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে রয়েছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেও নানা টালবাহানা করছে মিয়ানমার। এই অবস্থায় আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা অন্তত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আলোর মুখ দেখাতে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।